‘হরিলুটের বাতাসা’ মানে হরির পুজায় বিলানো প্রসাদ, যার প্রতি অধিকার সবার সমান। কিন্তু সে প্রসাদ ভাগ করে দেয়া হয়না, ভক্তদের মাঝে ছিটিয়ে দেয়া হয় তাই যারা সামনে যেতে পারে বা শক্তি প্রয়োগ করে কুড়িয়ে নিতে পারে তারাই সেটার অধিকারী হয়। এতে কোন নিয়ম-নিতির বালাই নাই। যারা সে প্রসাদের নাগাল পায়নি তাদের যদি কিছুটা প্রদান করে যারা দুই হাত ভরে নিয়েছে সেটা তাদের মহানুভবতা।
বাংলাদেশে এখন যা চলছে তাকে হরিলুট বলা যায়? মনে হয় বলা যায়, তা না হলে যারা সরকার ও প্রশাসনে আছে তাদের হাতে এতো সম্পদ জমা হলো কীভাবে?
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী-সচিব থেকে পিয়ন চাপরাশি হয়ে নিরাপত্তা কর্মী বিলিয়ন থেকে শত বিলিয়ন টাকার মালিক হয়ে গিয়েছে! তাও আবার পুরাটাই লুটের টাকায়! ভাবা যায়! যে সারা জীবনেও ২কোটি টাকা বেতন পায়নি সেও বহু বিলিয়ন টাকার মালিক!
বেনজির দিয়ে শুরু হয়ে নিরাপত্তা কর্মী পর্যন্ত অনেকের কোটি কোটি টাকার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। আরও কত যে আছে তার হিসাব হয়তো চলছে, আশা করি তাদের নাম ও সম্পদের আনুমানিক পরিমান প্রকাশিত হবে। আপাতত আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।
জঙ্গলে থাকতে হলে বাঘের নাগাল এড়িয়ে চলতে হয়। তেমন অপরাধীকে অপরাধ করে পাড় পেতে হলে সৎ প্রশাসকের থেকে দূরে থাকতে হয়। আমাদের জানানো হয়েছে এবং হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী একজন আপদমস্তক সৎ মানুষ ও সৎ প্রশাসক(!) তাই কী? যদি তাই হয় তবে তার কাছের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এতো টাকার মালিক হয়ে গেল কী ভাবে?
দাপুটে পুলিশ কর্তা ‘বেনজির’ প্রতিটা স্টেপেই ছিলো দাপটের সাথে, সে বলতো সে শেখ হাসিনার লোক(!) সরকারে কেউ তখন তার কথার প্রতিবাদ করেনি। বেনজিরের অপরাধের হিসাব সামনে আসার পরে তখনকার সরকারের এমন ভাব যেন তারা বেনজির নামের কাউকে চেনেই না! না চিনুক। আমরা দেখি পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে কোন পথে?
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক! কি ভাবে সে এতো টাকার মালিক হয়েছে তিনি সেটাও বলে দিলে আমাদের এতো গবেষণা করতে হয় না তাকে নিয়ে। মাননীয়র কাছে সেটা আমদের জানিয়ে দেয়ার অনুরোধ থাকলো।
আর একটা কথা, তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক এটা শুনে তিনি তার পিয়নকে বরখাস্ত করে টাকা সিজ করেছেন। ভালো কথা, কিন্তু তাই যদি হয় তবে কত টাকা বাজেয়াপ্ত করেছেন? আর তাকে ছেড়ে দিলেন কেন? তারতো এর জন্য বিচার হওয়ার কথা, তা তিনি না করে ছেড়ে দিলেন কোন আইনে? তার কী বিচারিক ক্ষমতা ছিলো?
শুনেছি সেই পিয়নের দুইটা বহুতল বাড়ি আছে, সেটা কী বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো? না হলে কেন করা হলো না? তাকে পালিয়ে যেতে দেয়া হলো কেন? আর এ নিয়েতো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর গর্ব করার কিছু নাই যে তিনি পিয়নকে বরখাস্ত করেছেন, এটাতো তার ব্যার্থতা, অযোগ্যতা যে তার সামনেই একটা ক্লাশ ছাড়া পোষ্টের কর্মচারি তার ঘাড়ে ভর দিয়ে এতোগুলো টাকা তুলে নিলো। তার এ জন্য লজ্জা পাওয়া উচিত, উলটা তিনি লজ্জা না পেয়ে এ নিয়ে গর্ব করেছেন? কোনটা গর্বের কাজ আর কোনটা গর্হিত কাজ তাও কি তারা ভুলে গিয়েছে!
একজন পিয়ন, তার যোগ্যতা কতটা? তাকে যারা নিয়োগ দিয়েছে সেটা তারাই জানে, আমাদের তা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নাই। আমাদের প্রশ্ন সততার মূর্তপ্রতীক মিস হাসিনার চোখের সামনে যে সবসময় থাকতো তার হাতে ‘চেরাগ’টা গেল কোন পথে?
এই পিয়ন নাকি প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সহায়তায় সুপারিশ বানিজ্য করেছে! এখন প্রশ্ন হলো, কাদের কাছে সে সুপারিশ করেছে, এবং কাদের জন্য ও কী কাজের জন্য এই সব সুপারিশ করেছে?
একজন পিয়ন যদি ১কোটি টাকারও মালিক হয়ে যায় তবে বুঝতে হবে তাকে এটা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে, এতে তার মনিব বা তার কাছের কারো হাত আছে। একজন পিয়নেরতো আর প্রশাসনিক ক্ষমতা নাই কোন কর্ম সম্পাদনের। তবে কারা সেই কর্ম সম্পাদন করলো? যা দিয়ে পিয়ন ৪০০ কোটি টাকা অয় করল? সেই কর্মকর্তারা কত শত কোটি টাকা হাতিয়েছে এ থেকে? তাদেরকে দুদক ফোকাস করেছে? সেই লোক যাদের হাত ধরে এই ৪০০ কোটি হাতালো আমরা তাদের পরিচয় জানতে চাই। পিয়নের কথাতো বলে দিলেন। তখনকার প্রধানমন্ত্রী তাদের নাম বলবেন দয়া করে?
শুনেছি এই পিয়নের প্রোগ্রামে মন্ত্রীরা দল বেধে গিয়েছেন পেটপুরে খেতে! তো, তাদের কখনো মনে হয়নি এই লোক এতো টাকা কোথায় পেলো? নাকি মন্ত্রীদের ধারণা তাদের মতই ক্ষমতার কাছাকাছি যারা থাকে এটাই তাদের জন্য সাভাবিক? (আর এই মন্ত্রীগুলার আত্মমর্যাদা বোধ নাই! একটা পিয়নের প্রোগ্রামে দলবেধে যায় কোন বিবেচনায়? নিজেদের সামাজীক অবস্থাটা নিয়েও ভাবলো না? এতটাই অপদার্থ এই সব মন্ত্রীরা! এদেরতো এই পদে থাকারই যোগ্যতা ছিলো না তবে)।
নেতারা যেহেতু এই ভাবেই টাকা আয় করে সেহেতু তাদের কাছে এটা না হয় সাভাবিক, NBR, দুদক (যদিও এই সংস্থা ২টা শতভাগ দূর্নীতিগ্রস্থ) কী করেছিলো? এই পিয়নকে কেন ছাড় দিলো?
আমরা এখন আরও জানতে পারছি এই গুনধর নাকি MP হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো(!) কতবড় দুঃসাহস হলে এমন স্বপ্ন দেখা যায়? যদিও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেনের এক সময়ের পিএস এখন হাজার কোটির মালিক এবং তাকেই হারিয়ে এখন MP, তার মেঝো ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান, ছোট ভাই ইউনিয়ন চেয়ারম্যান! এক ঘরেই সব পদ! প্রশাসন এদের দেখলো না?
এরা মন্ত্রীদের নিয়ে চড়ুইবাতি খেলে! প্রশাসন দেখবে কী ভাবে?
এবার আসি হরিলুটে। হরি ধর্ম মতে স্রষ্টা। আর তার পুজাতে পুরোহিত ভক্তদের মাঝে বাতাসা ছড়িয়ে দেন, সে থেকে যারা যেমন সংগ্রহ করতে পারবে হরির আসির্বাদ তারা তেমন পরিমানে পাবে। তাই সবার আগ্রহ থাকে অন্যের থেকে এগিয়ে থাকায়।
এই যে হরিলুটে এতো ভক্ত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলো এদের হরিটা কে? আর পুরোহিতই বা কে? কার প্রসাদ এরা সংগ্রহ করেছে?
এখানে দেশ যদি হরি হয় তবে সরকার প্রধান পুরোহিত, আমরা এখন ধরে নিব তিনি দুই হাতে বাতাসা বিলিয়েছেন আর তার কাছে যারা ছিলো তারা লুটে এগিয়ে থাকলো। পুরোহিতকেইতো দেখতে হবে পিছনে যারা আছে তারও পেলো কিনা, তা না দেখে যদি শুধু সামনেই ছিটাতে থাকে তবেতো সে দুষ্টু পুরোহিত। তারতো সে পদে থাকারই অধিকার নাই।
এমন ঘটনায় যেকোন ভদ্র দেশের মন্ত্রীরা পদত্যাগ করত, সরকারও পরে যেতে পারত। আর আমরা নির্লজ্জের মত গর্ব করে বলছি তাদের বদলি করেছি, বরখাস্ত করেছি, বিচার করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আগে কেন এদের ধরা হলো না? এতোটা বাড়তে দেয়া হলো কেন?
যে গণমাধ্যম এতো অপরাধী খুঁজে বেড় করে আমাদের সামনে হাজির করল, যাদের জন্য আমরা এতোটা অপরাধের খবর জানতে পারলাম সরকার সেই গণমাধ্যমের চোখ, কান চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার জন্য সর্বক্ষণ ব্যাস্ত থাকে। যেসব ব্যক্তি এই দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের প্রতিই সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তবে কি আমরা ধরে নেব সরকারই ওদের পোষোক? বা সরকারই এসব করছে ওদের দিয়ে?
এখন আর একটা প্রশ্ন, এই বেনজির থেকে পিয়ন দেশ থেকে বেড়িয়ে গেল। তাদের ধরলো না কেন বা দেশ ছাড়তে বাধা দেয়া হলোনা কেন?
আমরা নিশ্চিত এমন বেনিজির, মতি, ড্রাইভার আর পিয়নের অভাব নাই এদেশে। তাদের উম্মুক্ত করে আটকে দেয়া হোক, তারা যেন পালাতে না পারে।
আমরা জানি বাংলাদেশে প্রতিটা ডিপার্টমেন্ট দূর্নীতিগ্রস্ত। এখানে NBR রিটার্ণ অনলাইনে অপডেট করে না আর এক্সপোর্ট, ইম্পোর্ট লাইসেন্স রিনিউ করতে হলে অনলাইনে রিটার্ণ আপডেট থাকতে হবে। এই ক্ষেত্রে হয় আপডেট করাতে স্পিডমানি দিতে হবে না হয় লাইসেন্স রিনিউ করাতে তা লাগবে। অথচ কন্ট্রোলারের অফিসে বড় করে লেখা আছে তারা দুর্ণীতি করে না। এই হল সৎ(!) মানুষদের অবস্থা, আর যারা নিজেদের সৎ দাবি করে না তাদের কি অবস্থা তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে।