প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা পালনকারী শকুনের অস্তিত্ব আজ বিপন্নপ্রায়। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলা হয় শকুনকে। প্রকৃতির সমস্ত বাসি, পচা, দুর্গন্ধযুক্ত মরা প্রাণীর দেহ ওরাই খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলে। রোগমুক্ত রাখে মানুষ এবং সমাজকে। বিভিন্ন রোগের জীবাণু যেমন অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা রোগের সংক্রমণসহ অন্তত ৪০টি রোগের ঝুঁকি থেকে মানুষ ও পশু-পাখিকে রক্ষা করে। শকুন আকাশে উড়ে বেড়ানোর সময় নিচের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায় বলে প্রাণীর মৃতদেহ দেখে নেমে আসে।
শকুন তীক্ষ দৃষ্টিবিশিষ্ট শিকারি পাখি। ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে শকুনকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। পুরাতন বিশ্বের দেশগুলো যেমন ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার শকুনগুলো অ্যাক্সিপিটারডাই পরিবারের অন্তর্গত। ঈগল, চিল এবং বাজপাখিও পুরাতন বিশ্বের শকুন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। আরেকটি হলো নতুন পৃথিবীর শকুন, যা ক্যাথারটিডি পরিবারের অন্তর্গত, আমেরিকার উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে অবস্থান। অভিন্ন বিবর্তন দ্বারা ঐ দুটি গোষ্ঠীর শকুনের চেহারা কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। সারা বিশ্বে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ছয় প্রজাতির শকুন। চার প্রজাতি স্থায়ী আর দুই প্রজাতি পরিযায়ী। এগুলো হলো রাজ শকুন, গ্রিফন শকুন বা ইউরেশীয় শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। সব প্রজাতির শকুনই সারা বিশ্বে বিপন্ন। স্থায়ী প্রজাতির মধ্যে রাজ শকুন অতি বিপন্ন।
কৃষিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক, ইঁদুর ও পোকামাকর জাতীয় জীবজন্তু মারার জন্য বিষ মিশ্রিত খাদ্য প্রয়োগ, বায়ুশক্তি উত্পাদনের যন্ত্রের পাখার সঙ্গে সংঘর্ষে এবং উঁচুগাছ ক্রমাগত কেটে ফেলায় প্রজননের স্থান মারাত্মক হ্রাস পাওয়ার জন্য শকুন বিপন্ন প্রাণিতে পরিণত হয়েছে। শকুন দেখতে কুিসত। আকারেও বেঢপ। ভাগাড় কিংবা মৃত প্রাণীর আশপাশে এদের বিচরণ। মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করে। তাই গড়পড়তা মানুষের শকুনের প্রতি নাক সিঁটকানো ভাব আছে।
সচরাচর শকুন বছরে একবার একটি ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের হার মাত্র ৪০ শতাংশ। অনেক সময় সেটিও ফোটে না। ফলে এদের প্রজননের হার খুব ধীর। বিষয়টি শকুনের বংশ বিস্তারের জন্যও হুমকি।
শকুন ডাইক্লোফেনাক বিষক্রিয়ার কারণে কিডনি বিকল হয়ে মারা যায়। ডাইক্লোফেনাক হলো একটি নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ যা ট্রমা এবং সংক্রামক রোগের কারণে প্রদাহ কমাতে গরু এবং মহিষের ওপর ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। গরুর কোনো চিকিত্সায় এ-জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহারের ফলে গরু যদি মারা যায়, আর যদি ঐ মরা গরু শকুন খায়, তবে বিষক্রিয়ায় নিমেষেই মারা পড়ে। ডাইক্লোফেনাকের পাশাপাশি কিটোপ্রোফেন, এসিক্লোফেনাক ও ফ্লুনিক্সিনি জাতীয় ওষুধও শকুনের মৃত্যুর কারণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। শকুন রক্ষায় দুটি ওষুধ নিষিদ্ধ করা ছাড়াও সরকার ২০১৩ সালে জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি গঠন করে। ২০১৪ সালে দেশের দুটি অঞ্চলকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়। প্রথমটি সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অংশ এবং দ্বিতীয়টি খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ। এছাড়া আইইউসিএনের সঙ্গে সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ২০১৫ সালে শকুনের প্রজননকালীন সময়ের জন্য দুটি ফিডিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে—একটি রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ও অপরটি সুন্দরবনে।
স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য শকুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শকুনের খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। শকুনের আবাসস্থল, বাসা খুঁজে বের করে তা সংরক্ষণ করতে হবে। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে পরিচিত পাখিটিকে বাঁচাতে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।