চট্টগ্রামের রাউজানের শিক্ষিত ধনাট্য পরিবারের একমাত্র পুত্র মোহাম্মদ মোহিতুল ইসলাম মোহিত আন্তর্জাতিক ছাত্র হিসেবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পড়ছিলেন আমেরিকার বোস্টনের বাঙ্কার হিল কমিউনিটি কলেজে। পড়াশোনার পাশাপাশি বাঙালি মালিকানাধীন দোকানে কাজও করতেন। কথাবার্তায় মার্জিত, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও সুশ্রী মোহিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সুশীল ভাবমূর্তি তৈরিতেও সক্ষম হয়েছিলেন।
একই কলেজের চার বন্ধুসহ পাঁচ বাংলাদেশি একটি গাড়ি ভাড়া করে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে একুশে উদযাপনের জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি সারা রাত একা গাড়ি চালিয়ে বাসায় আসেন। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল পৌনে ৮টায় জাতীয় চিড়িয়াখানার সামনের কানেকটিকাট অ্যাভিনিউতে (নর্থ-ইস্ট ডিসি) বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগামী একটি গাড়ি এসে তাদের গাড়িতে ধাক্কা দেয়। এরপর একাধিক গাড়ির সংঘর্ষে দুমড়ে-মুচড়ে যায় সিডান টেসলা গাড়িটি। দুর্ঘটনায় তারা মারাত্মকভাবে আহত হন।
দমকল বাহিনী ও ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল টিম এ দুর্ঘটনায় আহত সাত জনকে তাত্ক্ষণিকভাবে নিকটস্থ তিনটি হাসপাতালে ভর্তি করে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়েছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশি মোহিতকে (২১) জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে, রাজু আহমেদ (২৩) ও হুমায়ূন আহমেদকে (২৩) মেডস্টার হাসপাতালে এবং নাইমুল ইসলাম সজীবকে (২৪) হাওয়ার্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বোরহানউদ্দিন জাদিনকে (১৯) জরুরি বিভাগে চিকিৎসার পর রিলিজ দেওয়া হয়।
গাড়ির একমাত্র চালক মোহিতের অবস্থা ছিল শুরু থেকেই নাজুক। অবশেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি হাসপাতালের আইসিইউ কেবিনে চিকিত্সারত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাজু আহমেদের মস্তিষ্কেও রক্তক্ষরণ হয় অনেক বেশি। তার অবস্থাও গুরুতর। হুমায়ূনের ঘাড়, মুখ ও নাইমুলের বাম পা থেঁতলে গেছে। তাঁদের সার্বিক চিকিৎসা পুরোদমে চলছে। যদিও কারোরই কোনো নিকটাত্মীয় আমেরিকায় নেই। তারা বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাস ও দুর্ঘটনার খবর পেয়ে শুরু থেকে যারা এগিয়ে গিয়েছিলেন সেই অপরিচিতজনদের তদারকি ও তত্ত্বাবধানে আছেন। রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান স্বয়ং হাসপাতালে গিয়ে তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেন।
পরের শুক্রবার ভার্জিনিয়ার স্টারলিং শহরের মসজিদ এডাম সেন্টারে মোহিতের জানাজা শেষে শনিবার সকালে তার লাশ বিমানে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে পাঠানো হলে সেখানেই তার দাফন সম্পন্ন হয়। মৃতের লাশ ফিউনারেলে রাখা, জানাজা শেষে অন্যান্য প্রচলিত কার্যক্রম, মুসল্লিদের কাছে মৃতের জন্য শেষ দোয়া, কারো কোনো পাওনাদি পরিশোধের অঙ্গীকার করাসহ সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়। মৃতের কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন না থাকলেও দুর্ঘটনার প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশি হিসেবে অত্র এলাকার মিজানুর রহমান, মাশাদুল আলম রুপম, সুদূর বোস্টন থেকে আসা মোহিতের পরিচিত বন্ধুর বাবা কমিউনিটি এক্টিভিস্ট মোর্শেদ, সালাউদ্দিনসহ অনেকে সার্বিক সহায়তা করেন।
স্টারলিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাসুদ আহসান ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ফয়সাল আহমেদ, জানাজায় সহযোগিতা করে এবং মৃতের দেখাশোনা ও তদারকিতে জড়িত সবাইকে দুপুরের লাঞ্চে আপ্যায়ন করে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।
দুর্ঘটনায় মৃত ও আহতদের কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন না থাকায় এদের চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো অসুবিধা না হলেও দেশে তাদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে জড়িত থাকার কারণে, বাংলাদেশের কমিউনিটি ও দেশি সংবাদ মিডিয়া সম্পর্কে দুই-একটি কথা না বললে কিছুটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। বর্তমানে আমেরিকায় এমন কোনো স্ট্যাট, এমন কোনো বড় শহর নেই যে, সেখানে কমবেশি বাংলাদেশিরা বসবাস করে না। বাংলা সংবাদ মিডিয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য নিউইয়র্কে বেশি হলেও মিশিগান, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, ট্যাক্সাসসহ ওয়াশিংটন ডিসির ডিএমভি (ডিসি, মেরিল্যান্ড ও ভার্জিনিয়া) এলাকায়ও উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশি লোকজনের বসবাস। এখানে টিভি, বাংলা সংবাদপত্রসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নামি, অনামি ও বেনামে অনলাইন পোর্টাল আছে। আজকাল স্মার্ট ফোন হাতে বাংলা লেখা জানা মানুষও নিজেদের সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেন।
ঘটনার দিনদুপুরেই দুর্ঘটনা ও হাসপাতালে ভর্তির খবরটি ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রবিউল হাসান টেলিফোনে চট্টগ্রামের মাশাদুল আলম রুপমকে পৌঁছে দিয়ে যতটুকু সম্ভব দেখাশোনা করতে অনুরোধ করেন। রুপম সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে মুমূর্ষু মোহিতকে দেখে নির্বাক হয়ে চিন্তা করতে থাকেন, কী করে দূতাবাস, কমিউনিটি ও বাঙালি মিডিয়ায় তা প্রকাশের মাধ্যমে আহতদের নিকটাত্মীয় ও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। নিউ ইয়র্কের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমেও সংবাদটি প্রচার করার জন্য বেশ কয়েক জনকে অনুরোধ করা হয়। কমিউনিটির সচেতন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ফেসবুকসহ মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে দুর্ঘটনার সার্বিক বিবরণ দিয়ে তা পোস্ট ও প্রচার করা হয়।
বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসির কমিউনিটিও যথেষ্ট বড়। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা—সব কালেই প্রতি উইকএন্ডেই বিভিন্ন প্রোগ্রামে সরগরম থাকে। দর্শক-শ্রোতার পদচারণায় সব অনুষ্ঠানের হলরুম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। নিউ ইয়র্কে কম করে হলেও ১০-১২টি বাংলা পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল কমিউনিটির বিয়ে, সভা-সমিতির বিভিন্ন অনুষ্ঠান, দেশ থেকে আসা ইউনিয়ন নেতা, ওয়ার্ড কমিশনার, মেম্বারদের সংবর্ধনা দেওয়া থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েদের খত্নার অ্যাডভারটাজমেন্ট পর্যন্ত কোনো কিছুই বাদ যায় না। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলও এ দুর্ঘটনার নিউজটা শত তদবির-চেষ্টার পরও প্রচার করেনি। কেননা, এর থেকে তাদের নগদ অর্থপ্রাপ্তির কোনো যোগ ছিল না। অথচ পাশাপাশি আমেরিকান রেডিও-টিভিতে বুলেটিন আকারে সারা দিন সংবাদ প্রচার করে। ওয়াশিংটন পোস্টসহ বেশ কিছু সহনীয় পত্রিকা, টিভি ও অনলাইনে অনেক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে।
তথাকথিত কমিউনিটির যে নেতারা বিনা টাকায় গান শোনান, গরু-মহিষ-খাসি জবাই করে ফ্রিতে খাওয়ান। হাজার হাজার ডলারের চেক লিখে দেন কত শত কমিউনিটির সম্মেলন-মহাসম্মেলনে। এক নেতার এক দেশের মতোই এক নেতার এক সংগঠনের নেতারা অনেক ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব, যাদের পদচারণা ছাড়া কমিউনিটির কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই হয় না। যারা সন্তানের খতনা, বহুবার্ষিকী পালন থেকে শুরু করে চন্দ্রগ্রহণ ও অমাবস্যার তিথি পালনও বাদ দেন না, তাদেরই কাউকে দেখা যায়নি ঐ অসহায় বন্ধুবান্ধবহীন ও আত্মীয়স্বজনহীন আহতদের একটা কল করে বা খোঁজ নিতে। কিন্তু তারাই এই প্রবাসের তথাকথিত কমিউনিটির সুপ্রিয় সুহূদ মহাজন ও নেতৃবৃন্দ!