নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়। এ দেশের অসংখ্য পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, ঝরনা, জলপ্রপাত, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাচুর্য, ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন যেকোনো মানুষকে আকৃষ্ট করবে অনায়াসেই। হাজার বছর ধরে নানা জাতির মিশ্রণের ফলে সম্পদশালী এই জনপদ বহু সংস্কৃতির মিলনস্থল। প্রাচীন এই জনপদের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য যুগ যুগ ধরে মুগ্ধতা ছড়িয়ে আসছে দেশি-বিদেশি প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসু মানুষের মধ্যে। মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন বংশের শক্তিমান শাসকেরা তাদের অক্ষয় কৃর্তির নিদর্শন রেখে গেছেন ছোট ছোট জনপদে বিভক্ত এই বাংলার আনাচে-কানাচে। সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বকারী এসব স্থাপনা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ভান্ডারে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। ঐতিহ্যবাহী ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বার্তা বহন করা এসব স্থাপনার সম্মিলন দেশের হেরিটেজ ট্যুরিজমে মূল্যবান সংযোজন। বর্তমান বিশ্বে পর্যটনশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে হেরিটেজ ট্যুরিজমকে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
বর্তমান সময়ের কৌতূহলী পর্যটক মাত্রই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ঝুলিকে বাড়িয়ে নিতে বিভিন্ন স্থাপনা ভ্রমণের পাশাপাশি এর পেছনের ইতিহাস-ঐতিহ্য অনুসন্ধানের অভিপ্রায় নিয়ে নানা স্থান পরিব্রাজন করে থাকেন। এই দিক বিবেচনায় বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ তাদের পর্যটন খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হেরিটেজ ট্যুরিজমকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। বস্তুত, প্রত্নতাত্ত্বিক এসব স্থাপনা সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে সমৃদ্ধ করার সঙ্গে রয়েছে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগের হাতছানি। পর্যটনশিল্পের এই বহুমাত্রিক সম্ভাবনার ভিড়ে হেরিটেজ ট্যুরিজম প্রসারে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ অসীম সম্ভাবনার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করছে। আগেই বলা হয়েছে, হাজারো গৌরবময় ইতিহাস ধারণকারী নানা স্থাপনার সমাবেশ ঘটেছে এ দেশে। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের পুরোনো বৌদ্ধবিহার, সংঘারাম, মেঘালিথ স্তম্ভ, মোগল আমলের স্থাপনা, সুলতানি আমলের বিভিন্ন দুর্গ, পর্তুগিজদের তৈরি দুর্গ, অষ্টাদশ শতকের রাজধানী ঢাকার গৌরবময় সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন স্থাপনা এবং এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও তাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, যেগুলো ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাচ্ছে। মূলত হেরিটেজ ট্যুরিজমকে বিকশিত করার মাধ্যমে হারিয়ে যেতে বসা এসব নিদর্শন পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। বলতেই হয়, শুধু ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোই যে হেরিটেজ ট্যুরিজমের অন্তর্ভুক্ত, তা কিন্তু নয়। এ দেশের বৈচিত্র্যময় খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, লোকজ সংস্কৃতির নিজস্বতার ছাপ হেরিটেজ ট্যুরিজমের ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করেছে বহুলাংশেই। আর এসব ঐতিহ্যকে পুঁজি করে দেশের পর্যটনশিল্পের বাজার সৃষ্টি এবং আমাদের স্বকীয় সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যময়তাকে দেশ ও বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিফলিত করা সম্ভব।
উল্লেখ করা দরকার, হেরিটেজ ট্যুরিজমকে জনপ্রিয় করা সম্ভব হলে ঐতিহাসিক এসব স্থানের গুরুত্ব আরো বাড়বে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও তা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। ভূমিকা রাখবে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রেও। এজন্য দেশের পর্যটন খাতের উন্নয়নে যথোপযুক্ত, বহুমাত্রিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। পর্যটনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষত, সরকার, পর্যটন করপোরেশন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ অতীব প্রয়োজনীয়। এছাড়া বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা, ভাষাগত দক্ষতায় অভিজ্ঞ জনবল সৃষ্টি এবং পর্যটনশিল্পের প্রচার ও প্রসারের জন্য কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারলে এই শিল্পের উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, শুধু অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপযোগিতা বৃদ্ধি নয়, হেরিটেজ ট্যুরিজমের বিকাশ সম্ভব হলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুরাগী হিসেবে গড়ে তুলতে এই শিল্প রাখবে যুগান্তকারী ভূমিকা। সর্বোপরি একবিংশ শতকের ‘ভুবনায়নের যুগে’ হেরিটেজ ট্যুরিজম হতে পারে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।