বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৭ মে একটি ঘটনাবহুল তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ১৯৮১ সালের এই দিনে আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ছয় বছর নির্বাসনে বিপন্ন জীবন কাটিয়ে স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন। একটা জাতির নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জীবন-যৌবন সুখ-শান্তি—সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। জাতি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনৈতিক অধিকারপ্রাপ্ত বাঙালি জাতির স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রি মহল তাকে হত্যা করে সপরিবারে। তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেই সঙ্গে শেখ হাসিনার শিশুসন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও স্বামী পরমাণুবিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া বিদেশে অবস্থানের কারণে ঘাতকের হাত থেকে বেঁচে যান।
১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিবসটি যখন স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে তখন অজান্তেই চোখ ভিজে যায়! সেদিনের বিকালটি ছিল ঝড়বাদলে পরিপূর্ণ। রাজনীতি ও প্রকৃতির বৈরী হাওয়া উপেক্ষা করে বাংলার অসংখ্য মানুষ সমবেত হয়েছিল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে। ঢাকার বিমান বন্দরে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাংলা, ‘জয় বঙ্গবন্ধু, ধ্বনিতে মুখরিত হয়েছিল রাজধানী। বিমান বন্দর থেকে তিনি যখন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার জনতা স্বাগত জানায় প্রিয় নেত্রীকে। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনে যেন নতুন বিজয়ের উল্লাসভূমিতে পরিণত হয় গোটা বাংলাদেশ। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে পৌঁছে বিশাল মঞ্চে লাখ জনতার সামনে তিনি আবেগময় অথচ তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘আমি সব হারিয়ে আপনাদের মধ্যে ফিরে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’ জনতার উচ্ছ্বাসে তিনি আবেগ ধরে রাখতে পারেন নি। তিনি ভাষণে আরো বলেন ‘আমার আর হারাবার কিছু নেই। পিতা-মাতা—সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের মধ্যেই তাদের ফিরে পেতে চাই।
তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ এ সময় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সমাবেশ স্থল। এ ধ্বনি যেন ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আকাশে-বাতাসে। সমবেত জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল—‘পিতৃ হত্যার বদলা নিতে লক্ষ ভাই আছে বেঁচে, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’ উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যখন নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করছিলেন তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল ভয়ংকর। সামরিক বাহিনীর বুটের তলায় পিষ্ট হয়েছিল গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের নায়ক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বাংলার মসনদ দখল করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হন। তিনি নিজে দল গঠন করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে ১৫ আগস্ট হত্যাকারীদের পুরস্কৃতও করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশকেও ধ্বংস করেছিলেন। এমনি পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চরম সংকটে পতিত হয়। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃত্বে দেখা দেয় বিভাজন। পরস্পরে আস্থা, বিশ্বাসের জায়গায় দেখা দেয় বিরাট ক্ষত। দল নেতৃত্বের সংকটে পড়ে ভঙ্গুর অবস্থায় পতিত হয়। ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫, ১৬ ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী ঢাকা ইডেন গার্ডেনের সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী এবং সঠিক। শেখ হাসিনা দলের শীর্ষ পদে আসীন হওয়াতে বেঁচে যায় আওয়ামী লীগ ও দেশ। আজকে সেটা প্রমাণিত। আনন্দের মধ্যেও বেদনা প্রকটিত হয় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিজন হারানোর কারণে। তাই দিবসটি আনন্দ-বেদনার সন্ধিক্ষণে পরিণত হয়। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। অনেকে ভেবেছিলেন শুধু দলে ঐক্য ধরে রাখার জন্যই সাময়িকভাবে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছে; কিন্তু এ ধারণা মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে।
কেননা শেখ হাসিনা শিক্ষাজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তদুপরি বঙ্গবন্ধুর রক্ত তার ধমনিতে প্রবাহিত। তাই ঐতিহ্যগত কারণেই তিনি প্রাজ্ঞবান রাজনীতিকের প্রমাণ দিতে সক্ষম হয়েছেন। তার নেতৃত্বের গুণেই আওয়ামী লীগ পথ খুঁজে পেয়েছে এবং মহিরূপ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি দলকে ক্ষমতায় আনতে সক্ষম হয়েছেন। তার নেতৃত্বে দল টানা তৃতীয় বার এবং চতুর্থ দফা রাষ্ট্রক্ষমতা অনুশীলন করতে পেরেছে। আজ দেশ অন্য এক উচ্চতায় পর্যবসিত হয়েছে। দলের নেতৃত্ব গ্রহণ সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি ক্ষমতার জন্য রাজনীতিতে আসিনি। এসেছিলাম একটি হারানো স্বপ্ন উদ্ধার এবং একটি রক্তাক্ত আদর্শের পতাকা আবার তুলে ধরার জন্য।’ দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি গণতন্ত্রকে উদ্ধার করেছেন এবং বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে অনন্য মর্যাদায় আসীন করেছেন।