কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা শিবিরে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার হু হু করে বাড়ছে। এখন প্রতি সপ্তাহেই আক্রান্তের হার হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের মাঝেও ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জরুরিভাবে পদক্ষেপ না নিলে করোনা ভাইরাসের মতো ডেঙ্গুও মহামারি রূপ নিতে পারে এমন অভিমত চিকিৎসকদের।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নতুন ৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।
এখন এই হাসপাতালে ২৫ জন রোগী চিকিৎসাধীন এবং এর মধ্যে ৬ জন রোহিঙ্গা বলে জানান হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. মোমিনুর রহমান।
হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডের চিকিৎসক আব্দুল মজিদ জানান, সাধারণ ওয়ার্ডের পাশাপাশি শিশু ওয়ার্ডেও প্রতিদিন ডেঙ্গুরোগী আসছে। তবে বেশিরভাগই রোহিঙ্গা।
তিনি জানান, আক্রান্তদের মধ্যে গত সপ্তাহে চার বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা শিশু মারা গেছে। ওই শিশুর নাম জিসমা আক্তার। তার বাবার নাম কলিমউল্লাহ। এটিই রোহিঙ্গা শিবিরে ডেঙ্গুতে প্রথম কোনো রোগীর মৃত্যু বলে জানান তিনি।
সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। এখন দৈনিক দেড়শ থেকে ২শ রোগী ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ক্যাম্পের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর কোন রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলেই কেবল ক্যাম্পের হাসপাতালগুলো থেকে জেলা সদর হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হচ্ছে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের চিকিৎসা সমন্বয়ক ডা. আবু তোহা জানান, রোহিঙ্গা শিবিরে অন্য বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের হার অনেক। চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চারমাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের মোট সংখ্যা ছিল ২শ’র কম। আর মে মাস থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে।
তিনি জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলতি বছরের ১ম চার মাসে ডেঙ্গু ধরা পড়ে ১৭২ জনের। এরপর মে মাস থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে আগে যেখানে প্রতিমাসের পরিসংখ্যান রাখা হতো, সেখানে এখন প্রতি সপ্তাহের পরিসংখ্যান রাখা হচ্ছে।
ডা. তোহা জানান, জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ আকার ধারন করেছে ডেঙ্গু। এখন প্রতি সপ্তাহে আক্রান্তের হার হাজার ছাড়িয়েছে।
তিনি জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু ধরা পড়ে ৮৪ জনের, ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ৯ জনের, মার্চ মাসে ১৭ জনের এবং এপ্রিলে ৬২ জনের। এরপর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ১৮ জন, দ্বিতীয় সপ্তাহে ৪৫ জন, তৃতীয় সপ্তাহে ৭৬ জন এবং চতুর্থ সপ্তাহে ৯৭ জন ডেঙ্গুরোগী ধরা পড়ে।
জুন মাসে এসে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেড়েছে এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ৩০ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত এক সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ২৪২ জন। এরপর গত জুন এক মাসেই আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।তবে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ‘সিরিয়াস কেস’ নেই বলে জানান ডা. তোহা।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা.মো. মোমিনুর রহমান রোহিঙ্গা শিবিরে ডেঙ্গুর অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক জানিয়ে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একদিকে খুব ঘনবসতি, অন্যদিকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অপ্রতুল। পরিবেশ ও অবস্থানগত কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের হার দিন দিন বাড়ছে। ’
তিনি আরও বলেন, বর্ষাকালে চিপসের প্যাকেটসহ প্লাস্টিকের নানা বর্জ্যে পানি জমে থাকে। আর এই প্যাকেটগুলোই এডিস মশা প্রজননের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠেছে।
তিনি ডেঙ্গু প্রতিরোধে যেখানে সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলা, ঘরের আশেপাশে পরিষ্কার রাখা ও রাতের বেলায় ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দেন।
চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগ প্রথম দেখা দেয় ১৯৬৪ সালে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে আক্রান্তের হার ছিল খুব কম। এরপর ২০০২-০৩ সালে এবং ২০১৭ সালে পুনরায় বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগ দেখা দেয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে, ২০১৭ সালে দুই হাজার ৭৬৯ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। পরের বছর সেই সংখ্যা প্রায় চারগুণ বেড়ে ১০ হাজার ১৪৮ জনে দাঁড়ায়। আর এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে সেই সংখ্যা প্রায় ১০ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জনে। এর মধ্যে ১৭৯ জন প্রাণ হারান।