করোনা মহামারির মধ্যেও বিক্রি বেড়েছে ২০০ কোটি টাকা। এত পরিমাণ বিক্রি করার পরও মুনাফা কমেছে ৫৭ কোটি টাকার। এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে প্রকাশিত ক্রাউন সিমেন্টের আর্থিক বিবরণীতে। শুধু বিক্রি বাড়াই নয়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটির সুদ প্রদানে ব্যয় কমেছে। এতকিছুর পরও কীভাবে মুনাফা কমে তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। ব্যাপারটি খতিয়ে দেখবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
সিমেন্ট খাতের কোম্পানিটি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ২১-মার্চ-২২) পণ্য বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে ২০০ কোটি টাকা। কোম্পানিটির ব্যবসায় এভাবে ধারাবাহিক পতনে তালিকাভুক্তির ১১ বছরে ক্যাপিটাল এবং লভ্যাংশ, উভয় ক্ষেত্রেই লোকসান গুনছে বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানিটির ৯ মাসের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ২১-মার্চ-২২) ক্রাউন সিমেন্টের ১ হাজার ৪১৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। যার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল ১ হাজার ২১৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এ হিসাবে বিক্রি বেড়েছে ১৯৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকার বা প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ শতাংশ।
শুধু বিক্রি বৃদ্ধি ছাড়াও কোম্পানিটির সুদজনিত ব্যয় কমে এসেছে। তারপরও কোম্পানিটির নিট মুনাফায় পতন হয়েছে। কোম্পানিটির আগের বছরের ৯ মাসে এ খাতের ৪৪ কোটি ৩১ লাখ টাকার সুদজনিত ব্যয় এ বছরে কমে হয়েছে ২৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ব্যয় কমেছে ১৬ কোটি ৩২ লাখ টাকার বা ৩৭ শতাংশ। তারপরেও কোম্পানিটির ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে নিট মুনাফা কমেছে ৫৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বা ৮১ শতাংশ। এ কোম্পানিটির ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে বিক্রি মূল্য থেকে পরিচালন ব্যয়, সুদজনিত ব্যয় ও কর সঞ্চিতি বিয়োগ এবং অন্যান্য আয় যোগ শেষে নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ৯১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল ৭০ কোটি ২৫ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ৪ টাকা ৭৩ পয়সা।
মুনাফায় এই ধসের কারণ হিসেবে ক্রাউন সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিকে উল্লেখ করে ডিএসইকে জানিয়েছে, যা ডিএসইর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রাউন সিমেন্টের কোম্পানি সচিব মো. মোজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু আমাদেরই না, সিমেন্ট খাতের প্রতিটি কোম্পানিরই মুনাফা কমেছে। আমাদের আর্থিক প্রতিবেদনও ওয়েবসাইটে আছে। কারও সন্দেহ থাকলে তারা দেখে নিতে পারে।’
অন্য কোম্পানির কথা বলা হলেও একই সময়ে ব্যবসায় উন্নতি করেছে সিমেন্ট খাতের আরেক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের। যে কোম্পানিটির জন্য শুধু অভিহিত মূল্যে শেয়ার ইস্যু করা হয়েছিল। এই কোম্পানিটির ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন-২২) শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ১ টাকা ৮৭ পয়সা। যার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল ১ টাকা ৮৫ পয়সা।
এই সিমেন্ট কোম্পানিটির পর্ষদ চলতি বছরের ৬ মাসের ব্যবসায় ১৫ শতাংশ অন্তর্বর্তীকালীন লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যে কোম্পানিটির ২০২১ সালে ইপিএস হয় ৩ টাকা ৩৪ পয়সা। এর ওপর ভিত্তি করে রেকর্ড ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে কোম্পানিটির পর্ষদ। কিন্তু ভালো ব্যবসা দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে বুক বিল্ডিংয়ে উচ্চ দরে শেয়ার ইস্যু করা ক্রাউন সিমেন্ট এখন অনেক পিছিয়ে। কোম্পানিটির তালিকাভুক্তির কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) পূর্ব শেয়ারপ্রতি ২০০৮-০৯ অর্থবছরের ৯ টাকা ৩৯ পয়সার মুনাফা এখন ৯ মাসে মাত্র ৯১ পয়সায় এসে ঠেকেছে। যে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ করে ক্যাপিটাল ও লভ্যাংশ উভয় ক্ষেত্রেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়েছে।
এর আগে কোম্পানিটি ২০১০-১১ অর্থবছরে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। শুরুতে প্রতিটি শেয়ার ১১১ টাকা ৬০ পয়সার বিশাল দামে ইস্যু করে কোম্পানিটি। এতে প্রতিটি শেয়ারের প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ১০১ টাকা ৬০ পয়সা। ১০ বছর পরে একই কোম্পানি সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের ব্যবসায় ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা দিয়েছে। যা ইস্যু মূল্য বিবেচনায় ২ শতাংশেরও কম বা ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
এ কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরে ২০১১ সালে ৩৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেওয়ার পরে প্রতি শেয়ারে ব্যয় (কস্ট) দাঁড়ায় ৮২ টাকা ৬৭ পয়সা। এরপরে ২০১২ সালে ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেওয়ার পরে তা নেমে আসে ৭৫ টাকা ১৫ পয়সায়। ১০ বছর পর সেই কস্ট ভ্যালুর বাজার দর এখনও আছে ৭৪ টাকা ৪০ পয়সায়। এতে প্রতিটি শেয়ারে ক্যাপিটাল লোকসান আছে ৭৫ পয়সা।
২০১২ সালে লভ্যাংশ দেওয়ার পর ৭৫ টাকা ১৫ পয়সায় গত ১১ বছরে লভ্যাংশ পাওয়া গেছে মাত্র ১৯ টাকা। তবে ৭৫ টাকা ১৫ পয়সা ব্যাংকে এফডিআরে ৫ শতাংশ সুদেও বছরে ৩ টাকা ৭৬ পয়সা মুনাফা পাওয়া যেত বলে বলছেন বিনিয়োগকারীরা। সে হিসেবে এ ১১ বছরে মুনাফা হতো ৪১ টাকা ৩৬ পয়সা। অর্থাৎ, ব্যাংকে ৭৫ টাকা ১৫ পয়সা জমা রাখলে মুনাফা বাড়ত ২২ টাকা ৩৬ পয়সা। শুধু তাই নয়, লভ্যাংশ বেশি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপিটাল লোকসান থেকে রক্ষা পেত বিনিয়োগকারীরা।
ডিএসই সূত্র থেকে জানা যায়, তালিকাভুক্তির পর থেকে নিয়মিত হারে লভ্যাংশ কমিয়েছে কোম্পানিটি। ক্রাউন সিমেন্ট ২০১৩ সালে ৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদান করে বিনিয়োগকারীদের। এরপরে ২০১৪ সালে কমিয়ে ৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া হয়। যা ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১৫ সালে ২৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ২০ শতাংশ, ২০১৮ সালে ১৫ শতাংশ, ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ, ২০২০ সালে ১০ শতাংশ ও ২০২১ সালে ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।
উল্লেখ্য, ১৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের ক্রাউন সিমেন্টে ৭৬৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকার নিট সম্পদ রয়েছে। যাতে কোম্পানিটির গত ৩১ মার্চ শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৫১ টাকা ৬২ পয়সায়।