সরকারের নীতি-সহায়তার সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ ঠিক থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে পোশাক শিল্পখাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিজিএমইএ। গতকাল রবিবার চট্টগ্রামের বিজিএমইএ ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ে এ তথ্য জানান বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, গত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। চীন থেকে গত কয়েক বছরে অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে এসেছে। আগামী আট বছরে এর পরিমাণ আরো বাড়বে। চীন যেহেতু পরিবেশগত কারণে টেক্সটাইল থেকে সরে আসছে, ফলে সংগত কারণেই সেগুলো বাংলাদেশে আসবে বলে আমরা ধারনা করছি। আমরা এই সুযোগগুলো গ্রহণ করতে চাই।
ফারুক হাসান জানান, টেকসই পোশাক শিল্প গড়তে বিজিএমইএ পোশাক শিল্প রূপকল্প ঘোষণা করেছে। রূপকল্পের ২০ লক্ষ্যের অন্যতম হলো—২০৩০ সাল নাগাদ রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। এছাড়া অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে কার্বন নিঃসারণ ৩০ শতাংশ কমানো, টেকসই কাঁচামাল ব্যবহার ৫০ শতাংশে উন্নীতকরণ, শোভন কাজের পরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করা, পানির অপচয় ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা, ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার শতভাগে নামিয়ে আনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার ৩০ শতাংশ হ্রাস, নারী-পুরুষের সমতা শতভাগ নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান ৬০ লাখে উন্নীত করা, উত্পাদনশীলতা ৬০ শতাংশ উন্নীত করা।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ এবং সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব পোশাক প্রস্তুতকারক দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পেয়েছে উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আমাদের এখন ১৮৩টি লিড গ্রিন কারখানা রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ৬০টি প্লাটিনাম রেটেড এবং ১০৯টি গোল্ড রেটেড। ২০২২ সালে আমাদের ৩০টি কারখানা গ্রিন হয়েছে, যা কোনো একক বছরে সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্রিন কারখানার সংখ্যা। তবে আমরা এখানেই থেমে যেতে চাই না। বিজিএমইএ প্রতিনিয়ত কাজ করছে পোশাক খাতে গ্রিন কারখানার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য।
তিনি বলেন, সম্প্রতি সরকার বেনাপোলের পাশাপাশি ভোমরা, সোনা মসজিদ, বাংলাবান্ধা কাষ্টমস স্টেশনের মাধ্যমে সুতা আমদানির ক্ষেত্রে পার্শিয়াল শিপমেন্টের (আংশিক চালান) জটিলতা নিরসন করে আদেশ জারি করেছে যা পোশাক শিল্পকে আরো গতিশীল করবে। পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ আজ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে বিজিএমইএ প্রধান বলেন, ডেনিমের ক্ষেত্রে চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন প্রথম অবস্থানে। সরকারের নীতিগত সহযোগিতায় ইউরোপের বাজারে আমরা অতি শিগিগরই ১ নম্বর অবস্থান নিতে সমর্থ হবো বলে আশাবাদী।
কোভিড মহামারি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরপরই পোশাক শিল্প আবার নতুন করে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে দাবি করে ফারুক হাসান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের পোশাক শিল্পে। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালে ৩.২ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে ২.৭ শতাংশ এ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি, বিশ্ব বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালে ৪.৩ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৩ সালে ২.৫ শতাংশ এ দাঁড়াবে। ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানিসহ প্রধান বাজারগুলোতে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে, তা দৃশ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ সারা বিশ্বেই দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। উন্নত দেশগুলোও কৃচ্ছ্রসাধন করছে। সেসব দেশের মানুষও কমিয়ে দিয়েছে কেনাকাটা। তাই পোশাকের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
ফারুক হাসান বলে, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২২ সালে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ৪৫.৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানির নতুন রেকর্ড গড়েছে এবং ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ২৭.৬৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনের কারণ হলো—কাঁচামালের বাড়তি দামের কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং অপেক্ষাকৃত উচ্চ মূল্যের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি। তবে পণ্যের এই মূল্য বৃদ্ধির সুফল উদ্যোক্তারা নিতে পারছেন না। গত দেড় বছরে সুতার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬২ শতাংশ, কনটেইনার ভাড়া বেড়েছে ৩৫০-৪৫০ শতাংশ, ডাইস ও কেমিক্যালের খরচ বৃদ্ধি ৬০ শতাংশ, গত বছরের শুরুতে মজুরি বৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশ, গত পাঁচ বছরে পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ বেড়েছে। কোভিডের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা পরিচালনায় খরচ আরো বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তিন বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিদ্যুতের অপ্রতুলতার কারণে কারখানাগুলোতে ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। তিনি গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রত্যাহারের দাবির পাশাপাশি গ্যাস সঞ্চালনে সিস্টেম লস কমিয়ে আনা ও অবৈধ সংযোগ বন্ধ করে গ্যাসের মূল্য সমন্বয়ের আহ্বান জানান।