আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের অংশ হিসেবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ভেঙে গেছে। বহুদিন এই জোট ছিল অকার্যকর। মাঝেমধ্যে বৈঠক আর একে অন্যের অনুষ্ঠানে যাওয়া ছাড়া এই জোটের কোনো কর্মসূচি ছিল না। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০-দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান অনানুষ্ঠানিক সভায় শরিকদের ডেকে জানিয়ে দেন, এখন থেকে কেউ যেন ২০ দলীয় জোটের নাম ব্যবহার না করে। এর উদ্দেশ্য, দলগুলো যাতে যার যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয়। একসঙ্গে থাকার এক দশক পর এই জোট ভেঙে যাওয়ার পটভূমিতে ২০ দলীয় জোটে থাকা দলগুলো আলাদা প্ল্যাটফরম গড়তে উদ্যোগী হয়।
এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘১২ দলীয় জোট’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ নামে ছয়টি দলের একটি পৃথক জোট ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে। আর আলাদা থাকছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। এই তিন দল এককভাবে কর্মসূচি পালন করবে। ইতিপূর্বে সাত দলের ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ বিএনপির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে।
এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, যারা জোট গঠন করছেন, তারা দলগতভাবে আমাদের ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেবেন। যেহেতু ২০ দলীয় জোট আনুষ্ঠানিকভাবে নেই, তাই সমমনা দলগুলো নিজেরা জোট করছে ভবিষ্যতে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য।
বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী এই নতুন জোট ও দলগুলো সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ৩০ ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি হিসেবে রাজধানীতে গণমিছিল করবে। বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, বিএনপির ডাকে ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলের মাধ্যমে শুরু হচ্ছে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন। সেদিন বিএনপি ছাড়াও আরও ৩৬টি রাজনৈতিক দল যুগপৎ আন্দোলনে রাজপথে থাকবে। তারা চারটি প্ল্যাটফরমে আলাদা মোর্চা গঠন করে বিএনপির সঙ্গে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
১২টি দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ
গতকাল বিএনপির সমমনা ১২টি দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। ১২ দলীয় এই জোটে রয়েছে মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জাফর), মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ডা.মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সৈয়দ এহসানুল হুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় দল, কে এম আবু তাহেরের নেতৃত্বে এনডিপি, শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বাধীন এলডিপি (একাংশ), অ্যাডভোকেট জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, মুফতি মহিউদ্দিন ইকরামের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাওলানা আবদুর রকীবের নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট, ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, অ্যাডভোকেট আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, এখন থেকে বলবেন ১২ দলীয় জোট। ২০ দলীয় জোট নয়। তিনি বলেন, ডিসেম্বরের ৯ তারিখ গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক ছিল। ১০ ডিসেম্বরের ব্যাপারে পরামর্শসভা ছিল। সেখানে বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতৃবর্গ, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বলেন, এখন থেকে ২০ দলীয় জোট নামটি আর ব্যবহার করবেন না। তবে আপনারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একসঙ্গে চলতে পারেন। এরূপ অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যের পর ২০ দলীয় জোটের অস্তিত্ব আর থাকে না। সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, যদিও আনুষ্ঠানিক প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে ২০১২ সালের এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ ২০ দলীয় জোটের জন্ম হয়েছিল। তবে জোটের বিভক্তিটা আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি, অনানুষ্ঠানিক হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ছিলাম ২০টি দল। ২০টি দলের মধ্যে প্রধান শরিক বিএনপিকে বাদ দিলে থাকে ১৯টি দল। দ্বিতীয় সারিতে জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিলে থাকে ১৮টি। জনাব পার্থের (আন্দালিব রহমান পার্থ) দল বিজেপি চলে গিয়েছিল ২০১৯ সালে, থাকে ১৭টি। খেলাফত মজলিশ চলে গিয়েছিল ২০১৯ সালে, থাকে ১৬। সেই ১৬ দলের মধ্যে আপনাদের সামনে আমরা ১২টি দল উপস্থিত আছি। তবে হ্যাঁ, এর মধ্যে বক্তব্য আছে। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম দল ছিল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, যার সভাপতির নাম অলি আহমেদ বীরবিক্রম। তার দলটি আমাদের এখানে নাই। তার দলের সাবেক অতি সিনিয়র নেতা আবদুল করীম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে একটি দল হয়েছে, যার নাম বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি), ওনারা এখানে আছেন।’
মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘একটা কথা আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারি, এ দেশের সর্ববৃহত বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে আমাদের যে ঐক্য, যে সমঝোতা, যে হৃদয়ের বন্ধন, তা অটুট থাকবে। আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনি আছে। আমরা আরও বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার জন্য প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের সব কয়টি রাজনৈতিক দল, যারা এই সরকারের বিরোধী, তাদের এক কাফেলায় শামিল করার জন্য একটু ভিন্ন পথ ও কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি।’ ২০ দলীয় জোটের ভাঙন নিয়ে ‘ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই’ মন্তব্য করে মোস্তফা জামাল বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে এ টু জেড ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের পথে যুগপত্ভাবে এগিয়ে যাব।’
জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদার সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ছাড়াও লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বাংলাদেশ এলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম, এনডিপির আবু তাহের, জাগপার তাসমিয়া প্রধান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মহিউদ্দিন ইকরাম, মুসলিম লীগের শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা আবদুল করিম, ইসলামিক পার্টির আবুল কাশেম, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সৈয়দ নুরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। প্রসঙ্গত, ১২ দলের মধ্যে নিবন্ধিত দল মাত্র দুটি। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ। তবে বাকিদের অনেকেই আবেদন করেছে।
আসছে ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’
জানা গেছে, ১২ দলীয় জোটের পর প্রথম পর্যায়ে ছয়টি দল নিয়ে ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ গঠন করা হচ্ছে। এর নেতৃত্বে থাকছেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। এই জোটে আরও থাকছে সাইফুদ্দীন মনির ডেমোক্রেটিক লীগ (ডিএল), খন্দকার লুত্ফর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) একাংশ, সাদেক শাওনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ, আজহারুল ইসলামের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী) ও গরীবে নেওয়াজের বাংলাদেশ পিপলস লীগ।