‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’—বাঙালি জাতির ভাষা আন্দোলন দিবস হিসেবে পরিচিত ২১শে ফেব্রুয়ারি অনন্য স্বতন্ত্রতার জন্য ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে আছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৯৪৮ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এক অধিবেশনে নিম্ন থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতির প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য হলে এর প্রতিবাদ করে ছাত্রসমাজ। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ছাত্রসমাজ দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় বারের মতো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই পরিষদের অন্যতম সদস্য।
নবগঠিত পরিষদ ১১ মার্চ হরতাল আহ্বান করে। বঙ্গবন্ধুসহ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৩-১৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। পাকিস্তানের গভর্নর মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির যড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন জিন্নাহ। তিনি ঘোষণা করেন—উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়। এরপর ২৪ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনের অনুষ্ঠানে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির চরম প্রতিবাদ জানান, তুমুল প্রতিবাদধ্বনি উচ্চারিত হয় সেদিন থেকেই। জিন্নাহর ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের দ্বারা ভাষা আন্দোলন জোরদার হলেও পরবর্তী সময়ে গোটা দেশবাসী ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। ফলে ছাত্রদের মনোবল বেড়ে যায় এবং তারা এগোতে শুরু করে নির্দ্বিধায়।
দুই পর্বে বিভক্ত এই আন্দোলন ১৯৪৮ সালে অনেকটা শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হলেও ১৯৫২ সালের আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্র ভাষা-রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা চাই-বাংলা চাই’ স্লোগানে ছাত্রসমাজ মিছিল বের করে, মুখরিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালালে ভাষাশহিদদের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারসহ সব বীর শহিদকে, যারা ভাষার জন্য, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। বাঙালির সাহসিকতার ইতিহাস আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতির পেছনে রয়েছে দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা। এর পেছনে মূলত ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনই হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল ভিত্তি। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের (ইউনেসকো) ১৬০তম অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইউনেসকো প্লেনারি সেশনে বাংলাদেশের প্রস্তাবে সর্বসম্মত এ স্বীকৃতি প্রদান করে, যা ছিল ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহিদদের সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন। এর মাধ্যমে ভাষার জন্য বাঙালি জাতির আত্মবিসর্জন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়। ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এই বিশেষ দিবসটিকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ প্রথম বারের মতো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে। এরপর থেকে প্রতি বছরই ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
ইউনেসকোর পর জাতিসংঘও ৫ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর ‘শান্তির জন্য সংস্কৃতি’ শীর্ষক একটি রেজুলেশনে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এটি তুলে ধরে। ভারত, জাপান, সৌদি আরব, কাতারসহ বিশ্বের ১২৪টি দেশ এ রেজুলেশনটি সমর্থন করে। প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ইউনেসকোর সদর দপ্তরসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রে নিজ নিজ মাতৃভাষার আলোকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এই দিবসটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি গৌরবময় ও অবিস্মরণীয় দিন। আমরা মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি তা বিশ্বব্যাপী অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। বিশ্বের খুব কম জাতিই তাদের মাতৃভাষার মান রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। আমাদের ভাষা আন্দোলনই আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত।
বাংলা ভাষাচর্চার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, আজ আমরা স্বাধীনভাবে গাইতে পারছি, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়াও বহির্বিশ্বে (ব্রিটেন ও আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি) চর্চা হয়ে থাকে। এছাড়াও চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ২১টি দেশে কমবেশি বাংলা সংস্কৃতি চালু আছে। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া ও ভার্জিনিয়া শহরের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষা চর্চা করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশে রেডিওতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। ব্রিটেনে বেতার বাংলা নামে রেডিও স্টেশন পরিচালনা করা হয় এবং নিয়মিতভাবে বাংলা ভাষার সাপ্তাহিক পত্রিকা পাওয়া যায়। বর্তমানে এশিয়া ও আমেরিকার দেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতেও বাংলা দৈনিক পত্রিকাসহ বাংলা ভাষায় রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলা ভাষায় মুদ্রিত অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সারা বিশ্বে বাঙালির মননের বাতিঘর হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়। একুশ এখন সারা বিশ্বের ভাষা ও অধিকারজনিত সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক। সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অহংকার ‘শহিদ মিনার’।
বাঙালি জাতি কেবল ভাষা আন্দোলন করেই ক্ষান্ত হয়নি। ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এ জাতির মধ্যে যে চেতনার উদ্রেক হয়, উনসত্তর থেকে একাত্তরে তার চরম বিস্ফোরণ হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর শুধু ভাষাশহিদ দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বাঙালির জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় ভাষার জন্য লড়াই করা ২১। তখন থেকেই আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়। এই সংগ্রামী চেতনাই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক আন্দোলন—এই দুই ধারাকে একসূত্রে গেঁথে মুক্তিসংগ্রামের মোহনায় এনে দিয়েছে। যে-কটি চেতনার উন্মেষে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সৃষ্টি, ভাষা আন্দোলনের সেই মোহনীয়তা ছিল উল্লেখযোগ্য। এ আন্দোলনই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। বাঙালি দীপ্ত পথ-পরিক্রমা ধাপে ধাপে এগিয়ে যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা রণাঙ্গনে।
মূলকথা, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকরা রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তারা বাঙালিদের মাতৃভাষার ওপর চরম আঘাত হানে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে প্রেরণা দিয়েছে একুশের ভাষা আন্দোলনের রক্তরাঙা ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনকে তাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বীজ বপনের সঙ্গেও তুলনা করা যায়।