১৯৭১ সালের উত্তাল ৩ মার্চ। চারদিকে স্বাধীনতার গান। এদিন ছিল রংপুরের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরে প্রথম শহিদ হয় ১১ বছরের টগবগে কিশোর শঙ্কু সমাজদার। সেদিনের সেই মিছিলে যে ২০-২৫ জন কিশোর ছিল, তার মধ্যে আমিও একজন। উর্দু ও ইংরেজি সাইনবোর্ড ভাঙার কাজে ছোটদের দুটি দল ছিল। একটি মিছিলের পেছনে, আরেকটি মিছিলের সামনে। এমনি এক সাইনবোর্ড ভাঙতে গিয়ে অবাঙালির বাড়ি থেকে ছোড়া গুলিতে প্রাণপ্রদীপ নিভে যায় শঙ্কুর। নিজের চোখের সামনে দেখেছি, শঙ্কুর মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় অবাঙালি শরফরাজের বাড়ি থেকে ছোড়া গুলিতে। একাত্তরের স্মৃতিরোমন্থন করলে প্রথমেই আসে এই শহিদজননীর দুঃখের কথা। স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতা-উত্তর সব স্মৃতি শহিদজননী বুকে ধারণ করে রাখলেও স্বাধীনতা ভোগকারী জনগণ তাকে ভুলতে বসেছে। কিন্তু তিনি কিছুই ভোলেননি। চোখের পানি আর মনের আশা নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন তিনি। রংপুরে শহিদদের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হলে সরকারি প্রশাসনসহ সুধীমহলের সাধুবাদ আর প্রাইজবন্ডই যার এখন সঙ্গী। গর্বিত এই শহিদজননীর নাম দিপালী সমজদার, যিনি আর কেউ নন, দেশের প্রথম দিকের অন্যতম শহিদ শঙ্কুর গর্বিত মা। শহিদ শঙ্কু সমজদারের বাবা স্বর্গীয় সন্তোষ কুমার সমজদার। শঙ্কুর মা এখন অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী।
শহিদ শঙ্কুর শৈশব কাটে রংপুর শহরের গুপ্তপাড়া এলাকায়। অগ্নিঝরা ৩ মার্চ ১৯৭১ উত্তাল বাংলায় রংপুরের এই মা তার ছেলে শঙ্কুকে আগলে রাখতে পারেননি। শত বাধার বাঁধন ছিঁড়ে মায়ের কোল ছেড়ে সেদিন রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে শঙ্কু। এরপর আর ঘরে ফেরেনি। শহিদ শঙ্কু প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষ করে রংপুরের সেনপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য ভর্তি হয়েছিল রংপুরের কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ে। বয়স তখন ১১। ক্লাস সিক্সে পড়ে। আমিও রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সেভেনের ছাত্র। স্বাধীনতার ৫১ বছর পর কেমন আছেন এই শহিদজননী, সেই খবরও কেউ রাখেনি। রংপুর শহরের কামালকাছনার সাবেক পেট্রোলপাম্পের গলিতে একটি সরকারি বাসায় ‘শঙ্কু ভিলা’য় থাকেন প্রায় শত বছর বয়সী এই শহিদজননী। তার সঙ্গে থাকতেন বড় ছেলে কুমারেশ সমজদার। তিনিও পরলোকে গমন করেছেন।
সেদিন কী ঘটেছিল নিজের দেখা :সকাল থেকে রংপুর নগরী ছিল গুমট। সকালবেলা বাসা থেকে পৃথকভাবে বেরিয়ে পড়ে শঙ্কু। শহরের প্রধান সড়কে আসতেই দেখে উত্তাল মিছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে জয় বাংলার মিছিলে। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে শুরু হওয়া মিছিলটি সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে রেল স্টেশন হয়ে আবারও শহরের দিকে আসার সময় ঘোড়াপীর মাজারের কাছে শঙ্কুর চোখে পড়ে উর্দুতে লেখা একটি সাইনবোর্ড। শঙ্কু এগিয়ে যায় ঐ সাইনবোর্ড নামাতে। আমরা বেশ কজন সে সময় শঙ্কুর পাশেই ছিলাম। সাইনবোর্ডে কেউ কেউ ঢিল ছুড়ছিল। ঠিক তখনই অবাঙালি সরফরাজ খানের বাড়ির ভেতর থেকে চালায় গুলি। ঢিলের আওয়াজ ও গুলির আওয়াজের পার্থক্য বুঝতে পারিনি। সে সময় একজন পাশ থেকে বলে উঠল— গুলি করেছে, মাথা নিচু কর। ঐ বাড়ির সামনে কতগুলো তেলের ড্রাম ছিল। আমরা ড্রামের আড়ালে মাথা নিচু করে কিছুটা দূরে চলে আসি। কিন্তু সেই গুলি শঙ্কুর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। বাবাগো-মাগো বলে ডাক দিতে পারেনি। লুটিয়ে পড়ল নিথর নিস্তব্ধ রক্তাক্ত দেহ পিচঢালা পথের ওপর। স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হওয়ার ২২ দিন আগে আন্দোলনমুখর বাংলার সর্বপ্রথম শহিদ রংপুরের এই কিশোর শঙ্কু। তার সেই আত্মত্যাগের স্মৃতি আজো অনেকের কাছে অমলিন। সেই দিনের সেই মিছিলে আমিও ছিলাম। আমাদের গ্রামের ৮ থেকে ১০ জন কিশোর আমরা মিছিলের কখনো সামনে আবার কখনো পেছনে থেকে উর্দু অথবা ইংরেজি লেখা সাইনবোর্ড নামিয়ে ভেঙে ফেলতাম। শঙ্কুও সেদিন সাইনবোর্ড ভাঙতে চেয়েছিল। কিন্তু অবাঙালির গুলি তার মাথা ভেদ করে যায়। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে শঙ্কু। সে সময় সাহসী ভূমিকা রাখেন জুম্মাপাড়ার বাসিন্দা প্রয়াত পৌর কমিশনার মুসলিম উদ্দিন। তিনি একটি গাছের ডাল ভেঙে তাড়া দিয়ে গুলির কথা শুনে পলায়নপর মিছিলের কিছু মানুষকে সংগঠিত করেন এবং শঙ্কুর লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তিনিই কোলে করে নিয়ে আসেন শঙ্কুকে। পরে শঙ্কুকে হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
স্বাধীনতাসংগ্রামের বছরের ৩ মার্চ কিশোর শঙ্কুসহ আরও দুই জনের আত্মদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় রংপুরের মুক্তিযুদ্ধ। দিনটি রংপুরবাসীর কাছে ‘শঙ্কু দিবস’ হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। দিবসটি পালনে প্রতিবছরের মতো এবারও রংপুরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন সংগঠনসহ নবগঠিত শংকু স্মৃতি সংসদের পক্ষ থেকে আলোচনাসভাসহ বিস্তারিত কর্মসূচির আয়োজন করবে। এ ছাড়া তার পরিবারের পক্ষ থেকে পারিবরিকভাবে পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতাকামী রংপুরের মানুষের অন্তরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত আগুন শংকুর মৃত্যুতে লেলিহান শিখায় পরিণত হয়।