রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জোরদার হতে যাচ্ছিল। মিয়ানমার সরকার রাজি না হলেও সুবিধাবঞ্চিত এসব নাগরিক জোট বেঁধে দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর তা আর এগোয়নি। মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গারা এখন গলার কাঁটা। তাদের ফেরত পাঠাতে দফায় দফায় উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। সংকট নিরসনে খুব একটা তৎপরতা নেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের। ফলে আদৌ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে কিনা, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইলেও সাড়া মিলছে না। এমন পরিস্থিতিতে পাঁচ বছরেও ঘরে ফেরার পথ খোলেনি রোহিঙ্গাদের।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে দলবেঁধে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছিল রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্মম নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ সরকার। ওই সময় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়। অবশ্য এর আগে সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে কক্সবাজারে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। যদিও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছিল মিয়ানমার সরকার। কিন্তু সেই প্রত্যাবাসন আজো শুরু হয়নি। এতে দীর্ঘ হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তিন দফায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে গেছে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল। এ সময় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার আগ্রহী না হওয়ায় এখনও শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন। সর্বশেষ ১৯৯২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জনকে মিয়ানমার ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার।
কেন রোহিঙ্গাদের এখনও ফেরানো যায়নি এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এই ইস্যুতে যতটা এগিয়ে ছিল, সেটা মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে থমকে গেছে। এখন মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো ছাড়া কোনও উপায় নেই আমাদের।’পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে দুই দেশের নবগঠিত ‘অ্যাড-হক টাস্কফোর্স ফর ভেরিফিকেশন অব দ্য ডিসপ্লেসড পার্সনস ফ্রম রাখাইন’র এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রোহিঙ্গারা রাখাইনের বাসিন্দা ছিলেন কিনা, সেই যাচাই-বাছাইয়ে দেরির কারণ খুঁজে বের করতে কারিগরি পর্যায়ের এ আলোচনায় নিজেদের সদিচ্ছার কথা তুলে ধরেছে উভয়পক্ষ।
এরই মধ্যে মিয়ানমারে ক্ষমতার পালা বদলের পর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নেয়নি সামরিক সরকার। প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আট লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছে। এদের মধ্যে মিয়ানমার সব মিলিয়ে ৪২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা বাংলাদেশের কাছে ফেরত পাঠিয়েছে। তবে এদের সবাইকে মিয়ানমার নিতে চায় না। তাদের দাবি, তালিকায় কিছু সন্ত্রাসীর পাশাপাশি অনেকের নামের বানানসহ নানা তথ্য অসম্পূর্ণ রয়েছে।
অবশ্য রোহিঙ্গারা এসব বৈঠকের কিছুই বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন, যেভাবে এসেছেন, সেভাবেই হয়তো তাদের ফিরে যেতে হবে। এতে তাদের দাবি-দাওয়া ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। এজন্য আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস মিয়ানমারের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহর অনুসারী ছিলেন তারা।
জানতে চাইলে টেকনাফের জাদিমুড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি আবুল কালাম বলেন, ‘আমি ২০১২ সালে বাংলাদেশে এসেছি। তখন কক্সবাজারের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে ছিলাম। তখন এখানকার অবস্থা সত্যিই ভালো ছিল। কিন্তু এখন ভয়াবহ অবস্থা। ক্যাম্পে তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষ একেবারে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। এখন রোহিঙ্গারা হলো কচুরিপানা। মাটিতে যার শিকড় পৌঁছাতে পারে না। ঢেউয়ের তালে একবার এদিক, আরেকবার ওদিক ভাসে। যাদের নিজ দেশে নাগরিকত্ব নেই, নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত, তাদের কোনও আশা নেই। তবু নিজ দেশে ফেরার স্বপ্ন দেখি আমরা।’
রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সাধারণ সম্পাদক মো. জুবাইর বলেন, ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ না থাকায় আমাদের জন্য ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তিনি থাকলে এতদিন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেতো। কিন্তু এখন সেটির কোনও রাস্তা দেখছি না। বিশেষ করে মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে ক্যাম্পে ভয়ে প্রত্যাবাসন নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। সবাই আতঙ্কে আছেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে রাখাইনের যে প্রদেশে রাখার কথা বলছে, সেখানে এখনও গুলিবর্ষণের শব্দ শোনা যায়। ফলে সেখানে এই মুহূর্তে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ আছে বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া যেসব রোহিঙ্গাকে আইপিডি ক্যাম্পে রাখা হয়েছে, তাদের এখনও কেন গ্রামে ফিরতে দেয়নি মিয়ানমারের জান্তা সরকার। তাদের কথা আমি বিশ্বাস করি না। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়টি মিয়ানমারের সংসদে ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানাই। তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘পাঁচ বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। ক্যাম্পে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় কক্সবাজারের মানুষ ভয়ভীতির মধ্য রয়েছেন। প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।’