৭ জুন ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস। ঘটনাবহুল রাজনৈতিক ইতিহাসের বাঁকে ৬ দফার অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করে। ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম ঘটে; কিন্তু দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির। শত ভাগ ৯৫ শতাংশ বাঙালি অধ্যুষিত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে শাসনের নামে শোষণকার্যে মনোযোগী হয় শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাঙালি সোচ্চার হয়ে ওঠে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। রাজনৈতিক নানা ঘটনাপরম্পরায় শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালির মুক্তির দূতে পরিণত হন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় বাঙালি তার আসল ঠিকানা খুঁজে পায়। এই ৬ দফার ওপর ভিত্তি করেই স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা লাভ করেছিল।
১৯৬৬ সাল। আমি তখন কলেজের ছাত্র। পরবর্তী বছর ১৯৬৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগে যোগদান করি। ৬ দফা আমাকে দরুণভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ৬ দফার দাবি আদায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালে ৭ জুন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। হরতালের ডাকে সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এদিন ঢাকা, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১১ জন শহিদ হন পাকিস্তানি পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে। সিলেটের মনু মিয়া ছিলেন হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার। শহিদের রক্তে রঞ্জিত ৭ জুনকে তাই ৬ দফা দিবস হিসেবে পালন করে থাকি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু জানতেন, ৬ দফা পাকিস্তানি জান্তা শাসক কখনো মেনে নেবে না। ৬ দফাকে এক দফার আন্দোলনে পরিণত করার প্রচেষ্টায় দেশব্যাপী কর্মসূচি পালন করা হয়। পরবর্তী সময়ে যা এক দফার আন্দোলনেই পরিণত হয়েছিল।
৬ দফা হচ্ছে বাঙালি মুক্তির সনদ। স্বাধীনতার বীজ নিহিত। ৬ দফায় একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যৌথ সম্মেলন। সেই সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে পৌঁছান। ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি গোষ্ঠী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে। এদিন তিনি নিজেই সম্মেলন বর্জন করেন। ১৯৬৬ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬ দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকাসংবলিত ৬ দফা কর্মসূচির একটা পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। যার নাম ছিল ৬-দফা আমাদের বাঁচার দাবি। ২৩ মার্চ ১৯৬৬ আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উত্থাপন করা হয়। ১৮ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা নামে একটি বুকলেট প্রকাশ করে বিলি করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন তদানীন্তনকালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই ৬ দফাকে ম্যাগনাকার্টা বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কী ছিল এই ৬ দফায়? প্রথমত, পাকিস্তান সরকারের বৈশিষ্ট্য হবে ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সংসদীয় পদ্ধতি। অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ ও সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার প্রতিনিধি নির্বাচন জনসংখ্যার ভিত্তিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকারে দায়িত্ব থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় এবং তৃতীয় দফায় ব্যবস্থিত শর্তসাপেক্ষ বিষয়। তৃতীয়ত, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুটি পৃথক মুদ্রাব্যবস্থা, যা পারস্পরিকভাবে কিংবা অবাধে উভয় অঞ্চলে বিনিময় করা চলবে। অথবা এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একটি মুদ্রাব্যবস্থা চালু থাকতে পারে এই শর্তে যে, একটি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যার অধীনে দুই অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তাতে এমন বিধান থাকতে হবে যেন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর কিংবা মূলধন পাচার হতে না পারে। চতুর্থত, রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে। প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ে ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় রাজস্ব জোগান দিতে হবে। পঞ্চমত, যৌথ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, সেই অঙ্গরাজ্যের সরকার যাতে স্বীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে তার পৃথক হিসাব রাখতে পারে, সংবিধানে সেরূপ বিধান থাকতে হবে। বৈদেশিক সাহায্য ও বাণিজ্য সম্পর্কে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারগুলোর হাতে থাকবে। ষষ্ঠত, ফলপ্রসূভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সাহায্যের জন্য অঙ্গরাজ্যগুলোকে মিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে। উল্লিখিত ৬ দফা পাকিস্তানি জান্তা শাসক মানতে পারেনি বলেই এটি এক দফার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। কার্যত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করেন এবং এর ভিত্তিতে আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলার মাটিতে চিরতরে জান্তা শাসকের পতনের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। সুতরাং ৬ দফার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা বীজ রোপিত হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তা অঙ্কুরোদ্গম হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।