সারা বিশ্বে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো যখন প্রথাগত ফিজিক্যাল ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছে, ঠিক সেই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংক চালু করতে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় নতুন অর্থবছরেই ডিজিটাল ব্যাংকিং চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। ডিজিটাল ব্যাংকের রূপরেখা প্রণয়নের কাজ শেষ হয়েছে। নতুন অর্থবছরে বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংক চালু হবে আশা করা যায়। বর্তমানে দেশে প্রচলিত ধারার ব্যাংক রয়েছে মোট ৬১টি। শাখার পাশাপাশি এসব অনেক ব্যাংকের রয়েছে অনলাইন সেবা। প্রচলিত পদ্ধতিতে সরাসরি কাউন্টারে না গিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের সহায়তায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করাকেই ডিজিটাল ব্যাংকিং নামে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকসমূহ বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা দিয়ে থাকে। ডিজিটাল ব্যাংক শুধু মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করেই করা যাবে। প্রচলিত ব্যাংকগুলোতে এখনো টাকা লেনদেন, হিসাব দেখার মতো কিছু সেবা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে করা যায়। কিন্তু নতুন যে ডিজিটাল ব্যাংক চালুর কথা বলা হচ্ছে, সেখানে সব কাজ হবে প্রযুক্তিনির্ভর। কিন্তু ব্যাংকটি আমানত গ্রহণ, ঋণ দেওয়া থেকে অন্যান্য সব কাজই করবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান ২০২২ সালে ডিজিটাল ব্যাংক চালু করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ব্যাংকিং লেনদেন ক্যাশলেস করার সরকারের যে লক্ষ্য, তা বাস্তবায়নের জন্য ডিজিটাল ব্যাংকিংই একমাত্র উপায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের নীতিমালা চূড়ান্ত করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এতে নীতিমালার পাশাপাশি আবেদনের যাবতীয় ছক দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাংকের কোনো শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথ বা কোনো স্থাপনা থাকবে না। মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করেই ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী চলবে এই ব্যাংক। মোবাইল ফোন বা অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহকেরা এই ব্যাংকে লেনদেন করতে পারবেন। তাদের সশরীরে ব্যাংকের কোন শাখায় যেতে হবে না। তবে প্রধান একটি কার্যালয় থাকবে। তাদের এটিএম কার্ড বা এজেন্ট ব্যাংকিংও থাকবে না। তবে ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড বা অন্য প্রযুক্তিনির্ভর সেবা থাকবে। জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নিজস্ব তথ্যাদি আপলোড করে একজন হিসাব খুলতে পারবেন। একইভাবে ঋণ নেওয়ার জন্যও প্রয়োজনীয় নথিপত্র আপলোড করে ঋণের আবেদন করতে পারবেন। যারা বেতন-ভাতা বা ব্যবসার টাকা গ্রহণ করবেন, তারা অনলাইনে নিজের হিসাব নিতে পারবেন। এটি গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে এবং সেবাবঞ্চিত, কম সেবা পাওয়া এবং প্রত্যন্ত এলাকার (পার্বত্য জেলা, দ্বীপ ইত্যাদি) মার্কেট সেগমেন্টকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনতে এআই, মেশিন লার্নিং, ব্লকচেইন ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। প্রযুক্তিনির্ভর সেবা হওয়ায় এসব ব্যাংকের কোনো কোনো সেবা দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই পাওয়া যাবে।
নতুন এই উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইছে, বিদেশি কোনো ডিজিটাল ব্যাংক তথা সফট ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আসুক। কারণ, তাদের উচ্চ প্রযুক্তি, নিরাপত্তাব্যবস্থা, অভিজ্ঞতা ও বিনিয়োগ সবই রয়েছে। তারা এ দেশে ডিজিটাল ব্যাংকের সঙ্গে থাকলে গ্রাহকেরাও আস্থা পাবেন, তাদের আমানতও সুরক্ষিত থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনে বলা হয়েছে, প্রচলিত সব ব্যাংকের মতো এসব ডিজিটাল ব্যাংকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব বিধিবিধান, নির্দেশনা মেনে চলতে হবে এবং নজরদারির মধ্যে থাকবে। তাদেরও আমানতের একটা অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হবে। গ্রাহকের অভিযোগ বা অসন্তুষ্টির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। গ্রাহক চাইলে প্রধান কার্যালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ দিতে পারবেন।
এটা একটা সময়োপযোগী পদক্ষেপ। কিন্তু কথা হলো, এটা কি সবার জন্যই হচ্ছে? যদি স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়, প্রতিযোগিতামূলক হয় এবং যোগ্যদেরই অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো পদক্ষেপ হবে। বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে যেভাবে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তাতে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার সঙ্গেও কয়েক বছরের মধ্যেই মানুষ খাপ খাইয়ে নেবে। নতুন প্রজন্ম প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের তুলনায় এ ধরনের ব্যাংকিংয়ে বেশি আগ্রহী। সিংগাপুর, ফিলিপিনের মতো দেশেও দেখা গেছে, প্রচলিত ব্যাংকের তুলনায় ডিজিটাল ব্যাংক মানুষ বেশি পছন্দ করছে। আস্তে আস্তে অনেক কিছুই ক্যাশলেস হয়ে যাচ্ছে। আমরাও অনেক কেনাকাটায় নগদ টাকার পরিবর্তে মোবাইল ফাইন্যান্সিং সার্ভিস ব্যবহার করি, মোবাইল ফোনে কিউআর কোড স্ক্যান করে পেমেন্ট করি। এভাবেই ব্যাংকের অনেক সেবা পুরোপুরি ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। ব্রাঞ্চ ব্যাংকিংয়ের যে খরচ, সেটা ভবিষ্যতে অনেক ব্যাংক নিতে পারবে না। বাংলাদেশে যেখানে অনেক সময় প্রচলিত অনেক ব্যাংক নিয়ে অভিযোগ ওঠে, গ্রাহকের দিক থেকে আস্থার সংকট তৈরি হয়, সেখানে এসব ডিজিটাল ব্যাংকের ওপর গ্রাহকেরা কতটা আস্থা রাখতে পারবেন? এখনো কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর আস্থা রেখে অসংখ্য মানুষ লেনদেন করছে। সেটাও একটা ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা। এক্ষেত্রেও হবে। তবে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তভাবে নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা সবার জন্য সমান এবং স্বচ্ছ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের মধ্যে। সেই সঙ্গে সাইবার সিকিউরিটির বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। নতুন এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে যখন আসবে, এর সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের সম্পৃক্ত করে এগিয়ে নেওয়া উচিত। প্রচলিত ব্যাংকের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার কারণেই ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের কথা আসছে। কিন্তু বর্তমানে যে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে, সেখানে যেমন বলা হয়েছে, এমডিকে হতে হবে ব্যাংকিং সেবায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞ। তাহলে তো সেই প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের চিন্তাভাবনা থেকেই ডিজিটাল ব্যাংকিং চালু করা হচ্ছে। কিন্তু এখানে বরং প্রযুক্তিতে দক্ষ নতুন চিন্তাভাবনার লোকজনকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এটা তো একপ্রকার স্টার্টআপ। লাইসেন্স দেওয়ার হার সীমিত না রেখে উন্মুক্ত রাখা উচিত। তখন বাজার নির্ধারণ করে দেবে, এই ব্যাংকিং খাত কেমন হবে।