হঠাৎ করে দেশজুড়ে তীব্র হয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। মূলত গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে টান পড়ে বেড়েছে ভোগান্তি। গ্যাস সরবরাহ বাড়লেই শুধু লোডশেডিং থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে শিগগির জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম কমার সম্ভাবনা নেই। বরং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে চড়া দর আগামী মাসগুলোতে আরো চড়া হওয়ার আশংকা আছে। গ্যাসের সরবরাহ না বাড়া পর্যন্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছে।
কেন এই সংকট : তিন দিন ধরে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং অনেক বেড়ে গেছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। খোদ রাজধানীতেই দিনে ৫-৬ বার লোডশেডিং হচ্ছে। দেশের অনেক এলাকায় দিনের ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবি বলছে, পেট্রোবাংলা তাদের গ্যাস কম দিচ্ছে, এ জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে টান পড়েছে। আবার জ্বালানির দাম বেশি বলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছে না। এতে দেশজুড়ে ২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। পেট্রোবাংলা বলছে, গত দুই সপ্তাহে গ্যাস সরবরাহ ৩০ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে এলএনজি কিনছে না বাংলাদেশ। জুন মাসে স্পট মার্কেট থেকে তিনটি এলএনজি কার্গো কেনা হয়েছিল। জুলাই মাসে কোনো কার্গো কেনার উদ্যোগ নেই। বিশ্বে চলমান জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী বাজারের কারণে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে সরকার সাশ্রয়ী নীতি বাস্তবায়নে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে।
সংকট সহসা কাটছে না : দাম না কমলে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হবে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। অন্যদিকে, সংকট কাটাতে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান।
সূত্র জানায়, এলএনজি সরবরাহ কমায় গ্যাস ঘাটতি বেড়েছে ৩০-৩৫ কোটি ঘনফুট। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যে উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, তা কোনোভাবেই আগামী কয়েক মাসের চেষ্টায় ১০-১৫ কোটি ঘনফুট উৎপাদন বাড়বে না। জ্বালানি তেলের দামও বেশি বলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে পারছে না পিডিবি। ফলে চলমান গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট খুব শিগগিরই কাটবে না বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম কমলেই শুধু দেশের বিদ্যুৎ-গ্যাস পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্য বলছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং কভিড-পরবর্তী চাহিদা বাড়ায় আগামী কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের দাম বাড়তির দিকে থাকবে। বাজার বিশ্নেষণকারী সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস বলছে, জাপান ও ইউরোপের চাহিদা বাড়ায় এলএনজির দামও ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে।
সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে নসরুল হামিদ বলেন, ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক দেশই জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হয়েছে। বাংলাদেশকেও একই পথে যেতে হবে।
২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং :পিডিবির তথ্যমতে, রোববার দেশে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। গতকাল সোমবার লোডশেডিং ২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী ডিপিডিসি ৩০০ মেগাওয়াট ও ডেসকো ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) চাহিদার চেয়ে ৮০০-৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। আরইবির বাইরে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা নেসকো ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। দক্ষিণের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ওজোপাডিকো ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতিতে রয়েছে। ফলে এসব এলাকার গ্রাহকরা দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। গতকাল দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট, পিডিবি সরবরাহ করেছে ১৩ হাজার মেগাওয়াট।
জ্বলছে না চুলা, কারখানা বন্ধ :গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বারিধারা, বাড্ডা, মুগদা, মতিঝিল, গোপীবাগ ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় একদমই গ্যাস পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। আর কাঁঠালবাগান, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বেশকিছু এলাকায় গ্যাসের চাপ অনেক কমে গেছে। কোনোরকমে রান্নার চুলা জ্বলছে এসব এলাকায়। সাভার, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এলাকার শিল্পকারখানাও গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক উৎপাদন করতে পারছে না বলে অভিযোগ আসছে। গতকাল দেশে ৪৫০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহ করেছে ২৮২ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া গেছে ৫০ কোটি ঘনফুট।