ভালোর দিকে পরিবর্তনই হচ্ছে উন্নয়ন। আর অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর উন্নততর অবস্থায় উত্তরণই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির উন্নততর অবস্থা এখনো সর্বজনীন হয়নি। ঘটেনি নব্য ঔপনিবেশিক অর্থনীতির অবসান। দেশের সম্পদ নানাভাবে, নানা উপায়ে লুট হয়ে যাচ্ছে। পরোক্ষ অর্থনৈতিক শোষণে বিপর্যস্ত বিশ্বও। একচেটিয়া বাণিজ্য, দুর্নীতি ও সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে পৃথিবী জুড়ে বাড়ছে সম্পদের বৈষম্য। অক্সফামের প্রকাশিত রিপোর্ট মতে, ৪৬০ কোটিরও বেশি গরিবের চেয়ে ২ হাজার ১৫৩ জন কোটিপতির সম্পদ বেশি। এদিকে ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’ বলছে, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। গত পাঁচ বছর ধরে এই প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে। কিন্তু এর সুফল সাধারণ জনগণের নাগালের মধ্যে পৌঁছানোর জন্য দূরদর্শী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা নেওয়া হয়নি। ফলে দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় বৃদ্ধিতে জনগণ হয়ে পড়ছে বিপর্যস্ত ও অসহায়। গতকাল অনলাইন পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এক কেজি মরিচের দাম দাঁড়িয়েছে ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ, এক কেজি খাসির মাংসের সমান।
এদিকে বাংলাদেশকে মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বর্গ হিসেবে অভিহিত করেছে প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস। মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা জরিপে ৮০ শতাংশ বাংলাদেশি মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ভালো বলে উল্লেখ করেছেন। পুঁজিবাদ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতি সমর্থনের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। শীর্ষস্থানে থাকা ভিয়েতনামের ৯৫ শতাংশ মানুষ মুক্তবাজার ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। এই তালিকার বাংলাদেশের পরবর্তী তিনটি অবস্থানে আছে যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ঘানা। ৭২ শতাংশ ভারতীয় মুক্তবাজার সমর্থক আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা আরো কম—৬২ শতাংশ। নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের মূল নিয়ামক ছিল জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতেও ক্রমবর্ধমান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিতে কাহিল অবস্থায় রয়েছে কেন দেশের সাধারণ মানুষ? আসলে বৈশ্বিক পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে আড়তদার ও বাণিজ্য সিন্ডিকেট অধিক মুনাফা লাভের আশায় পণ্য গুদামজাতকরণ এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করছে।
এক্ষেত্রে উলটো প্রশ্ন করা যায়, দীর্ঘ তিন দশকে আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতিকে কতটা কল্যাণমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি? অনেকেই বলে থাকেন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং প্রয়োজনীয় নৈতিকতার ঘাটতির কারণে বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। মহলবিশেষের কারসাজির কারণে মুক্তবাজার অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। ফলে এই ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত সুফল আমরা ভোগ করতে পারছি না। রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসৃত হলেও বাজার কার্যত মহলবিশেষের প্রভাবের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই যখন-তখন কোনো পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মতো ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। বাজারে সঠিক বিপণনব্যবস্থা না থাকার কারণে অধিকাংশ সময়ই উত্পাদক ও ভোক্তার মধ্যে সরাসরি সংযোগ ঘটছে না। মধ্যস্বত্বভোগীরা উত্পাদক ও ভোক্তার মধ্যে সংযোগ সাধনের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। এতে উৎপাদক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। আর ভোক্তাও তুলনামূলক কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারছে না। এমতাবস্থায় উত্পাদক ও ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা, উত্পাদনের সঙ্গে যাদের কোনো যোগসূত্র নেই। মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল সূত্রই হচ্ছে—বাজারে একটি পণ্যের চাহিদা এবং জোগানের ওপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারিত হবে। আর এই মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হলো ভোক্তার সার্বভৌমত্ব ও পূর্ণ প্রতিযোগিতার স্বীকৃতি। ক্রেতা কম মূল্যে যেকোনো ভালো জিনিস বেছে নেওয়ার অধিকার রাখে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুক্তবাজার অর্থনীতি আর লুম্পেন অর্থনীতি এক নয়।
পুরাণে ইঁদুরকে লুটেরা, মজুতদার, মধ্যস্বত্বভোগী, স্বার্থপর, সর্বভুক ও আত্মসাত্কারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। ইঁদুর রাতের আঁধারে সম্পদ হরণ করে নিজের ডেরায় তা মজুত করে। দিনের বেলায় আলোতে ইঁদুর খাদ্য-সম্পদ আহরণ করে না। কেবল অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে সম্পদ লুট করে। নিজের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সম্পদ মজুত করে সর্বগ্রাসী ইঁদুর। বিপুল সম্পদের মাঝে নিজে ভোগে আনন্দ পায়। আবার ইঁদুর যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে। পৌরাণিককাল থেকে অদ্যাবধি ইঁদুরের দেশের সম্পদ লুণ্ঠন অব্যাহত রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, প্রতি বছর ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকার শস্য ইঁদুরের পেটে চলে যাচ্ছে। সংসদের তথ্যানুযায়ী (২০১৪-১৫) অর্থবছরে ইঁদুরের কারণে ৭২৩ কোটি ৭২ লাখ ৭ হাজার ৩৫৫ টাকার শুধু ধান, চাল ও গমের মতো ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আর তার পরিমাণ হলো ধান প্রায় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৪৪ মেট্রিকটন, চাল প্রায় ৬২ হাজার ৭৬৪ মেট্রিকটন এবং গম ফসলের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৯ হাজার ৬৬০ মেট্রিকটন। দেশের কয়েক হাজার ধনাঢ্য ব্যক্তির পুঁজি লুটপাটের আকর্ষণীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ব্যাংকিং খাত। অধিকাংশ ঋণই ফেরত পাওয়া যায় না। ঋণ ফেরত না দেওয়ার বিষয়টি এখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে ধনাঢ্য ব্যক্তির প্রবৃদ্ধি হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? পুরাণে লুটেরা মজুতদার ইঁদুরের বিপরীতে প্যাঁচাকে সম্পদের রক্ষক ও সমবণ্টনকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাই ইঁদুর তাড়ানোর জন্য প্যাঁচা দিয়ে জৈবিক উপায়ে ইঁদুর দমন করার কথা বলা হয়। মজুতদার, লুটেরা ও সর্বগ্রাসী ইঁদুরকে তাড়াতে খ্রিষ্টীয় বারো শতকে জার্মানির হ্যামিলন শহরে এসেছিলেন এক বাঁশিওয়ালা। ইঁদুররূপী মানুষ লুটেরাদের কে তাড়াবে? অনেকেই মনে করেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার বাজারের ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাই বাজারে কোনো একটি পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পেলেও সরকারের তেমন করণীয় থাকে না—এই ধারণা মোটেও ঠিক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুক্তবাজার অর্থ ফ্রি স্টাইল মার্কেট নয়। কোনো কারণে বাজারে অস্বাভাবিকতা বা অস্থিরতা সৃষ্টি হলে অবশ্যই সরকার সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে। বাজার প্রক্রিয়া যাতে সঠিকভাবে চলে, তার ব্যবস্থা করা সরকারেরই দায়িত্ব। মজুতদার, লুটেরা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর এক্ষেত্রে উত্পাদন ও বিপণন সমবায় সমিতি গঠন, তাদের সাশ্রয়ী (৩-৪ শতাংশ) সুদে ঋণদান, খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি; এতে অগ্রাধিকারভিত্তিক সমবায়ী ধান, চাল, পেঁয়াজ, আলু রাখার ব্যবস্থা করা হলে উত্পাদনকারীরা নিজের ফসল সমবায়ের মাধ্যমে নিজেই কিনে গুদামজাত করবেন এবং বছরব্যাপী তা বিক্রি করে নিজেরা এখনকার চেয়ে বেশি দাম পাবেন এবং ক্রেতারা কম দামে কিনতে পারবেন। মূল্য থাকবে স্থিতিশীল।
উত্পাদন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষতা ও যোগ্যতা নিশ্চিত করতে না পারলে মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে আমাদের কল্যাণ আসবে না। এর জন্য সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করতে হবে, আইনের শাসন তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং পরিকল্পিত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বহু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে দেশীয় শিল্পকে তুলনামূলক যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। না হয় মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে দেশীয় শিল্পের ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত হয়ে ধ্বংসের মুখে উপনীত হয়ে দেশীয় শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ হতে পারে।