নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি, জনজীবন, চাষাবাদ—প্রায় সবই নদীনির্ভর। তাই বলা হয়, নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। অথচ বহু নদী এরই মধ্যে মরে গেছে। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বহু নদী হারিয়ে গেছে। পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে বহু নদীর তলদেশ। বর্তমান সরকার বদ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় দেশের ৬৪ জেলায় ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনর্খননের কর্মসূচি হাতে নেয়। অনেক নদী ও খালের খননকাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু খননের সঠিকতা নিয়ে যেমন অভিযোগ আছে, তেমনি আছে খনন-পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। এক সময় সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা যে বাংলা-প্রকৃতির কথা বলা হয়, সেখানে নদনদীর অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখন সেই নদনদীও নেই, হারিয়ে যেতে বসেছে সেই শ্যামল ও প্রশান্তির প্রকৃতিও। গোটা দেশের চিত্রই এমন। সবকটিই দখল ও দূষণে বিপর্যস্ত।
নদীদূষণ ও দখল পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। পরিবেশবাদী সংগঠন ও পরিবেশবাদীরা এ ব্যাপারে যতই সোচ্চার হোক না কেন, কাজ হচ্ছে না। যারা পরিবেশ দূষণ করছে তারা শুধু প্রকৃতির শত্রুই নয়, মানুষেরও শত্রু।
নগর জীবনে বেদখলকৃত নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাধার উদ্ধার ও সংরক্ষণের গুরুত্ব এখন প্রায় সবাই স্বীকার করেছেন। উপর্যুপরি জলাবদ্ধতার কারণে বিষয়টি বর্তমানে একরকম গণদাবিতেও পরিণত হয়েছে বলা যায়। সে জন্য সারা পৃথিবীতে চলছে নদী বাঁচাও আন্দোলন। ভারতের নর্মদা আন্দোলন থেকে নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন সবখানে চলছে নদী রক্ষা করার লড়াই। একসময় পাশ্চাত্যেও নদী নিধন করে উন্নয়ন অব্যাহত রাখার একটা ভ্রান্ত প্রয়াস চলছিল। এ ছাড়া নদী ভরাটের মাধ্যমে জমি দখলের মহোৎসবে অনেক প্রভাবশালীই জড়িত। মনে রাখতে হবে নদনদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। দূষণ এবং অবৈধ দখলের হাত থেকে নদী বাঁচাতেই হবে। আরও দুঃখজনক হচ্ছে, কোনো কোনো নদীর ওপর তৈরি করা হয়েছে অপরিকল্পিত সেতু ও কালভার্ট। শুধু সড়ক উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নদী ও একে জনজীবনের স্বার্থের কথা একবারের জন্যও ভেবে দেখেনি। ফলে একটি জেলায় এতগুলো নদী, যার একটিও এখন সুস্থ নেই। মৃতপ্রায় এসব নদনদীকে বাঁচাতে নানা সময় খননসহ নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনেক নদী মরে যাচ্ছে, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। অনেক নদী হারিয়ে গেছে। একসময়ের খরস্রোতা নদীর বুকজুড়ে দেখা দিচ্ছে ধু-ধু বালুচর। শুকনা মৌসুমে পানি নেই। বর্ষা মৌসুমে এই নদীই আবার দুই কূল ছাপিয়ে দুর্দশার কারণ হয়। বর্ষার পানি ধারণ করার ক্ষমতা নেই বেশিরভাগ নদীর। সুষ্ঠু পরিচর্যার অভাবে নাব্য হারিয়েছে অনেক নদী। এমন অনেক নদী আছে, যে নদীতে একসময় স্টিমারসহ বড় বড় নৌকা চলত, সেসব নদী এখন হেঁটে পার হওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা নদীর আজ খুবই করুণ দশা। এ রকমই একটি নদ পুরোনো ব্রহ্মপুত্র। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের খাগডহর, পুলিশ লাইন, কাচিঝুলি এলাকা, কাচারী ঘাট, জুবিলী ঘাট, কালীবাড়ীসহ বেশ কিছু এলাকায় নদের বিরাট অংশজুড়ে চর। কোথাও নালার মতো পানি বইছে। কোথাও হাঁটুপানি। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল প্রবাহ ফেরাতে নদী খনন করা হোক। পাঁচ বছরমেয়াদি প্রকল্পে নদে খনন চলছে। শুধু পুনর্খনন নয়, পুনর্খননের মান ও পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথভাবে সম্পন্ন করা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে নদী আরও বেশি ভরাট হওয়ার আগে নাব্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হোক।
কর্ণফুলীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যেভাবেই হোক কর্ণফুলী নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে অবিলম্বে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ দেখতে চাই। কারণ চট্টগ্রামকে বাঁচাতে হলে কর্ণফুলীকে বাঁচাতেই হবে।