চামড়াজাত পণ্যের প্রধান কাঁচামাল চামড়ার বড় অংশ আসে কোরবানির ঈদের সময়। এই চামড়ার মান ভালো বলে অপেক্ষায় থাকেন ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা। যদিও কয়েক বছর ধরে দুর্দশা চলছে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণে। কোরবানির পর পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া এবং মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটছে।
তবে এবার চামড়া নষ্ট হওয়া ঠেকানো এবং ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তদারক করবেন। পাশাপাশি চামড়া স্থানীয়ভাবে সাত দিন পর্যন্ত যেন সংরক্ষণ করা যায়, সেটা নিশ্চিত করা হবে। এরপর রাজধানীতে নেওয়া হবে।
এই বিষয়ে গতকাল সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে তৃণমূল প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেছে।
এদিকে আজ মঙ্গলবার সকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই বছরের কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করবে। মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করবে বলে জানিয়েছে। সূত্র জানায়, গত বছরের চেয়ে সরকারি পর্যায়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ দাম বাড়ানো হবে।
এ ছাড়া এবার সদ্যোবিদায়ি অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে ১২৪ কোটি ডলারের। ফলে চামড়ার পুরনো মজুদ কমে আসায় চাহিদাও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। মজুদ আছে পর্যাপ্ত লবণ। পাশাপাশি ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির পথ সুগম হওয়ায় এবার ঈদে চামড়া সংগ্রহে ‘দুঃসময়’কাটবে বলে আশা করছেন এ খাতের অনেকেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ কালের কণ্ঠকে বলেন, কোরবানির পশুর চামড়া নষ্ট হওয়া ঠেকাতে এবং ন্যায্য মূল্য পেতে স্থানীয় পর্যায়ে এবার চামড়া সংরক্ষণ করা হবে। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক, উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তদারক করবেন।
এই বছর কোরবানির পশুর লবণজাত চামড়া সংগ্রহ করা হবে উল্লেখ করে তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ওই চামড়া লবণ দিয়ে সাত দিন স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হবে। এরপর রাজধানীতে আসবে। এতে চামড়ার নষ্ট হওয়া ঠেকানো এবং ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা যাবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে আজ কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করা হবে। বিশ্ববাজার ও রপ্তানি আয় সব মিলিয়ে আশা করা যাচ্ছে, এবার ৫ থেকে ১০ শতাংশ দাম বাড়ানো হতে পারে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে ৯৭ লাখ। এক কোটি ২১ লাখ পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া লবণেরও কোনো ঘাটতি নেই। কোরবানির ঈদে ৮২ হাজার টন লবণ প্রয়োজন হয়। এরই মধ্যে কোরবানির পশুর জন্য প্রয়োজনীয় লবণ ব্যবসায়ীরা মজুদ করেছেন। শিল্প মন্ত্রণালয়কে এরই মধ্যে আরো দেড় লাখ টন লবণ আমদানি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।জানা যায়, সরকারি সংস্থা বিসিক এবং লবণ মিল মালিক সমিতি হাট পর্যায়ে লবণ সরবরাহ করবে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্ল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এ বছর ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেশি পশু কোরবানি হবে। আমাদের আশা, সরকারের নির্দেশনা অনুসারে স্থানীয় পর্যায়ে লবণজাত করে ঢাকায় চামড়া আসবে। এতে চামড়া নষ্ট কম হবে। একই সঙ্গে চামড়ার ন্যায্য মূল্যও নিশ্চিত করা হবে। ’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশে সারা বছর যেসংখ্যক পশু জবাই হয়, তার অর্ধেক হয় এই কোরবানির মৌসুমে। কোরবানি যারা দেয়, তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে। পাইকাররা সেই চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি সেরে বিক্রি করেন ট্যানারিতে। ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে, তা প্রতিবছর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪.৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১.৮২ শতাংশ ছাগলের, ২.২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১.২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে ঊর্ধ্বগতিতে কাঁচা চামড়ার চাহিদা তৈরির পাশাপাশি গত বছরের বিরাজমান কিছু সমস্যার সমাধান হওয়ায় এবার মাঠ পর্যায়ে কোরবানির পশুর চামড়ার দামে শৃঙ্খলা ফিরে পরিস্থিতি পাল্টাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এদিকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আশাবাদী হলেও কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রবিউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা না থাকায় ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া খাসি-ভেড়ার চামড়া না কেনায় প্রায় অর্ধেকই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দর বাস্তবায়নে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা নেই।
চামড়া খাত বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আবু ইউসুফ কালের কণ্ঠকে বলেন, চামড়া সংরক্ষণে সম্প্রতি এসংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণের উদ্যোগ, মসজিদ ও পাড়া-মহল্লায় চামড়া সংরক্ষণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা। এ ছাড়া সরকারের নির্ধারিত দর নিশ্চিত করতে স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তৎপর থাকবে। এ ছাড়া কোরবানির ঈদে চামড়া ব্যবস্থাপনার জন্য দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।