দেশব্যাপী তীব্র প্রকোপ ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু। এডিস মশাবাহিত এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা গত কয়েক দিনে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। সংক্রমণের এই হার যেন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে! মনে থাকার কথা, ২০১৮ সালে দেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়ংকর আকার ধারণা করে। বলা বাহুল্য, এবারের পরিস্থিতি এমন যে, আগের সব রের্কড ভেঙে যাবে যেন! ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ হতে নানা পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে, যাকে প্রশংসা করতেই হয়। দেশের সব জাতীয় পত্রিকা, টেলিভিশনে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক নানা প্রচারণাও চলছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীর ডেঙ্গু সংক্রমণের ব্যাপারে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এখনো দেশের মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে তেমন একটা সচেতনতা জাগ্রত হয়নি। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও কিছু করণীয় রয়েছে।
মনে রাখতে হবে, এখন বর্ষাকাল চলছে। এ সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ১২ থেকে ১৫ দিন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। তাই এ সময় এডিস মশার দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এডিস মশা ডেঙ্গু ও পীতজ্বরের মতো মারাত্মক দুটি রোগের বাহক। সাধারণত পুরোনো টায়ার, ঢাকনাবিহীন চৌবাচ্চা, ড্রাম, জলাধার, পোষা প্রাণীয় পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের বল্ক, ফেলে রাখা বোতল ও টিনের ক্যান, গাছের ফোকর ও বাঁশ, দেওয়ালে ঝুলে থাকা বোতল, পুরোনো জুতা, ফুলের টব, সুইমিং পুল প্রভৃতি স্থানে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার জন্ম হয়। এসব মশা শরীরে কামড় বসালে তাতে করে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। দুঃখজনক খবর হলো, ডেঙ্গু একটি সংক্রমণ রোগ হওয়ায় দ্রুত একজনের থেকে অপর জনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষ্যমতে, সাধারণত এডিস মশা কামড়ানোর ৩ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ডেঙ্গুর জ্বরের উপসর্গ দেখা দেয়। শুরুর দিকে তীব্র জ্বর ও শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে থাকে। এতে জ্বর উঠতে পারে ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত! জ্বর হওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন পর সারা শরীরে লালচে দানা দেখা যায়। তাছাড়া বমি বমি ভাব, অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করা, রুচি কমে যেতে পারে। অনেক সময় শরীরের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে মাথায়, চোখের পেছনে, হাড়, কোমর, পিঠসহ মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। এসব লক্ষ্মণ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছাড়াও ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকার মতো জটিল রোগের সংক্রমিত হতে পারে। তাই আমাদের সকলকে মশা নিধনের বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এডিস মশা পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে। অপরিষ্কার, ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে মশা ডিম পাড়ে না। তাই আমাদের চারপাশের কোথায় স্বচ্ছ পানি জমে আছে, তা লক্ষ রাখতে হবে। শহর অঞ্চলে অনেকেই শখ করে ছাদে বিভিন্ন ফুল-ফলের গাছ লাগিয়ে থাকে। অনেকে আবার অনেক অপ্রয়োজনীয় বালতি, বোতল ছাদে ফেলে রাখে বা প্রয়োজন হেতু মজুত করে। ঘর সাজানোর জন্যও পানিভর্তি ফুলদানি রাখে ঘরের ভেতরে। পানি জমে থাকা এসব পাত্র ভালোমতো ও নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। কারণ, পাত্রে থাকা পানিতে মশার লার্ভা থাকতে পারে, যা থেকে ডিম ফুটতে পারে। এছাড়া ঝোপঝাড় ও নালায় মশার জন্ম হয়। তাই বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় ও নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখতে হবে।
সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যার আগে এডিস মশার কামড়ানো প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই এ সময়ে কীভাবে মশার কামড় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে। অন্ততপক্ষে খালি শরীরে থাকা যাবে না। ডেঙ্গু সংক্রমণের ক্ষেত্রে বৃদ্ধ, শিশু ও অসুস্থরা থাকেন উচ্চ ঝুঁকিতে। তাই এ সময় তাদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে শরীরে প্রচুর পানি শূন্যতা দেখা যায়। কাজেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে বেশি বেশি পানীয় দ্রব্যাদি খাওয়াতে হবে, যেমন:লেবুর শরবত, ডাবের পানি, বিভিন্ন ফলের জুস ইত্যাদি খেতে দিতে হবে বেশি বেশি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে কখনো আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে সুস্থতা লাভ করা যায়। সুতরাং, কোনোভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, বরং মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের কালে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।