আগামীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হতে চায় জাতীয় পার্টি। এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন খোদ দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। কিন্তু আগামীতে কোন দল বা জোট ক্ষমতায় যাবে—এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। তাই জোট গঠনের ক্ষেত্রে কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন তিনি। কেননা তিনি মনে করছেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হলে দুটি জোটের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এবং নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে যেতে পারে। কাজেই পরিস্থিতি বুঝে জোট গঠনের বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। জি এম কাদের বলেছেন, জাতীয় পার্টি এখন ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। এ ব্যাপারে এখনই কোনো মন্তব্য করতে পারব না। বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতিতে অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে।
দেশের রাজনীতি কোন পথে?
জি এম কাদের : এটি স্বাভাবিক। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারই চেষ্টা করেছে নির্বাচনব্যবস্থা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নির্বাচন করতে। অর্থাৎ নির্বাচনের ফল নিজের পক্ষে নেওয়ার সব চেষ্টা করা হয়েছে। নির্বাচন-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম দলীয়করণ, আইন পরিবর্তন এবং নিজস্ব লোক ঢুকিয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে পুরো ব্যবস্থা সরকারের পক্ষে কাজ করে।
এমন প্রবণতা স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই শুরু হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক নির্বাচনের সময় এটি করা হয়েছে। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বিরোধীরা এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করে। অনেক সময়ই পরিবর্তন আনতে সফল হয়েছে। আবার কখনো কখনো সফল হয়নি। এবারও আন্দোলন চলছে এবং সেটি সফল হবে কি না, সেটি ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। তবে এটি বোঝা যাচ্ছে যে, নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত একটা আন্দোলন চলবেই। যারা পরিবর্তন চাচ্ছেন, তারা মনে করছেন সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা আয়ত্তের বাইরে নির্বাচনব্যবস্থাকে না নিয়ে নির্বাচন করার কোনো অর্থ নেই। এর মধ্যে কিছু সত্যতাও রয়েছে। বিরোধী দলের জায়গা থেকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ খুব কম। তেমনি সরকার চাইছে নির্বাচন ব্যবস্থাটা নিজের আয়ত্তে রেখে সহজে নির্বাচন জিতে আবার ক্ষমতায় যেতে। সরকার বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত এ জায়গা থেকে কোনোভাবেই সরতে চাইবে না। এ পরিস্থিতিতে দেশে আন্দোলন কতটুকু সফল হবে আমি জানি না। তবে এ পরিস্থিতিতে নতুন একটা বিষয় যুক্ত হয়েছে, তা হলো বিদেশি চাপ। বিদেশিরা চাচ্ছেন একটি সঠিক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এর অর্থ হলো, নির্বাচনব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে একটি নতুন নির্বাচনব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। এ বিদেশি চাপটি সরকারকে অনেকটা বেকায়দায় ফেলেছে।
এর কি কোনো সমাধান আছে?
জি এম কাদের : অবশ্যই এর টেকসই সমাধান রয়েছে। একবার ক্ষমতায় গেলে কেউ ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। ক্ষমতা অপব্যবহার করার এবং ভোগ করার একটা মানসিকতা আমাদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতায় গিয়ে তারা যখন দুর্নীতি লুটপাটে যুক্ত হয়, তখন তারা জনগণের কাছে জবাবদিহিতার কথা ভুলে যায়। যখনই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার প্রশ্ন আসে, তখনই তারা সেটিকে এড়িয়ে যেতে চায়। এর জন্য তারা নির্বাচনব্যবস্থা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়, যাতে জনগণের রায় ছাড়াই আবারও নির্বাচনে জিতে আসা যায়। দলগুলো এ ধরনের একটা ভাবধারা নিয়ে কাজ করে। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের রাজনীতিবিদরা কখনো চিন্তা করেন না যে, জনগণই দেশের মালিক এবং তাদের কাছে আমাদের জবাবদিহিতা করা উচিত। সেটা হলে দেশ ভালো চলে, দেশের উন্নয়ন টেকসই হয়, উন্নয়ন গণমুখী হয়, উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষ পায়। একই সঙ্গে দুর্নীতি, সরকারি সম্পদ লুণ্ঠন এবং মানুষের ওপর অত্যাচার-অনাচার, বৈষম্য ইত্যাদি কমে যায়। যখন সরকারকে জবাবদিহি করতে হয়, তখন সরকারকে অনেক ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে কাজ করতে হয়। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে লাগাম ছাড়া কাজকর্ম করার প্রবণতা গেড়ে বসে। দুর্নীতি করা, ক্ষমতার অপব্যবহার করা, জনগণকে তোয়াক্কা না করা, এগুলোতে ঝুঁকে পড়ে তারা। ফলে নির্বাচনব্যবস্থা নিজের হাতে না নিয়ে বা নিজের নিয়ন্ত্রণে না নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার সাহস তারা করেন না। এটা আমাদের জন্য, আমাদের রাজনীতির জন্য এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। নির্বাচনব্যবস্থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে একটা স্বাধীন সংস্থায় পরিণত করতে হবে। এটা কীভাবে করা যায় সেটার ফর্মুলা আমরাও দিতে পারি অথবা চাইলে বিশেষজ্ঞরাও দিতে পারেন। সবাই মিলে একটা ফর্মুলা গ্রহণ করলে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এমন একটা প্রক্রিয়া দরকার যার মধ্যে সরকার চাইলেই নির্বাচনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। অন্য কেউ চাইলেও এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এটা হবে জনগণের জন্য আলাদা একটি আদালত। এটা পৃথিবীর সব দেশই করে ফেলেছে, এমনকি আমাদের আশপাশের দেশগুলোও করে ফেলেছে। কিন্তু আমরা করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে ক্ষমতার লোভ এবং ক্ষমতা পেলেই কোনোভাবে তা ছাড়া যাবে না এবং যতটা পারা যায় সেটাকে অপব্যবহার করতে হবে—এমন প্রবণতা আমাদের একটা ভালো নির্বাচনব্যবস্থার দিকে যেতে দিচ্ছে না।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একমত হলে সমাধান খুবই সহজ। আমাদের দেশে এ জাগরণটা তখনই ঘটে, যখন আমরা বিরোধী দলে থাকি। তখন আমরা বুঝতে পারি যে এটি দরকার। আবার ক্ষমতা পেলে সেই দলই আবার এটি চায় না। ১৯৯০ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু হলো, তখন বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ সবার দাবিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলো। এরপর বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন দিতে চাইল। তখন আবারও জাতীয় পার্টি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ সবাই আন্দোলন করে। ফলে এরকম একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, স্বাধীনতার এতদিন পরও আমাদের মধ্যে সামান্যতম দেশপ্রেম তৈরি হলো না, জনগণের প্রতি এতটুকু দায়িত্ববোধ এলো না। দেশের প্রতি এতটুকু দায়িত্ববোধ এলো না যে, আমরা সবাই মিলে এমন একটা নির্বাচনব্যবস্থা তৈরি করব, যেখানে কারও কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। তাতে জনগণ তাদের অধিকারটা পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করতে পারবে। জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
এই মুহূর্তে আলোচনার ইস্যুতে পরিণত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন একটা সরকার। সরকার চাইছে না, কিন্তু বিরোধী দলগুলো চাইছে।
সমাধান কী হবে?
জি এম কাদের : বিএনপি একবার একই কথা বলেছিল যে, এটা সম্ভব নয়। তখন আমরা তা মানিনি। আওয়ামী লীগও মানেনি। এমনকি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, চিরস্থায়ীভাবে হলেও আমরা একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাই। কাজেই পরবর্তীকালে তিনি ক্ষমতায় এসে আবার এটাতে রাজি হচ্ছেন না। এখন বিএনপি এটা চাচ্ছে। আমরা শুধু নিজের সুযোগ-সুবিধা দেখতে চাই, যেখানে আমরা চক্ষুলজ্জাও করি না। এগুলোর পরিবর্তন হওয়া দরকার। অবশ্যই আমাদের দেশের রাজনীতির কালচারটা আমরা নষ্ট করেছি।
আমরা যে নেতৃত্ব দিয়েছি এটা কোনোক্রমেই কোনো আদর্শ নেতৃত্ব নয়। এটা একটা লোভ-লালসা ও ব্যবসাভিত্তিক রাজনীতি। রাজনীতি করব জনগণকে লুণ্ঠন করার জন্য, রাজনীতি করব একটা লাভজনক ব্যবসায়ী হিসেবে—এ ধরনের একটা প্রবণতা আমাদের রাজনীতিতে ঢুকে গেছে। এর থেকে আমরা বেরোতে পারছি না।
আমাদের বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য সমাজ যেদিকে কোনো সুযোগ-সুবিধা পান নীতির কথা চিন্তা না করে, দেশের কথা চিন্তা না করে তাতে সমর্থন দিয়ে দেন। এটি শুধু এ সরকারের আমলে হচ্ছে তা নয়, বরং এর বিপরীত সরকারের আমলেও হয়েছে। তখন এ সরকার এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এ খেলাটা চলছেই, এর শেষ কোথায় সেটা আমি বলতে পারব না, শুধু আল্লাহ বলতে পারবেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে নির্বাচনব্যবস্থা সরকারের কুক্ষিগত করা অথবা একেবারে নিয়ন্ত্রণ করা থেকে বাইরে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। এর জন্য অনেক ধরনের মডেল আছে, সেগুলোর মধ্য থেকে যে কোনো একটি মডেল নেওয়া যায়। অন্যান্য দেশ যেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করছে, আমরা সেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করছি না। অন্যান্য দেশ আমাদের মতো রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাইকে দলীয় নেতাকর্মী বানাচ্ছে না। দলীয় নেতাকর্মী হিসেবে তাদের ব্যবহার করছে না। দলীয় নেতাকর্মী ও গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে নির্বাচন কেন্দ্র দখল করছে না। এগুলো কোনো দেশে করছে না এবং করতে দেওয়া হচ্ছে না। দেশগুলোতে সব রাজনৈতিক দলই এখানে একমত হয়েছে।
নির্বাচন সম্পর্কিত প্রতিটি স্তরে এবং নির্বাচন কমিশনকে আমরা সম্পূর্ণরূপে কুক্ষিগত করে ফেলেছি। এমনভাবে কুক্ষিগত করা হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন যদি একটি ভালো নির্বাচন দিতে চায়ও, তবু তারা সেটা দিতে পারছে না। তাদের হাত-পা বাঁধা। তাদের হাত-পা সরকারের কাছে বাঁধা। এ সরকারের আমলেই গাইবান্ধার নির্বাচনে পরিষ্কারভাবে আমরা দেখেছি। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন বন্ধ করে দিল। আমরা একটা ভালো নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা দেখলাম। পরবর্তী সময়ে আমরা কী দেখলাম এ বিষয়ে তদন্ত হলো, কিছু মানুষ দোষীসাব্যস্ত হলো। কাউকে শাস্তি দেওয়া হলো না বরং কাউকে কাউকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে আবার যখন এই নির্বাচনটা হলো, তখন আবার একই প্রক্রিয়ায় সেই ভোট ডাকাতি করেই নির্বাচনটা হলো। ফলে নির্বাচন কমিশন যে অসহায় সেটি আবার প্রমাণ হয়েছে।
সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি মানতে চাইছে না আর বিরোধী দলগুলো এ দাবিতে অনড়।
পরিস্থিতি কতটা আশঙ্কাজনক?
জি এম কাদের : সমাধান যদি কেউ করতে চায় অনেক ধরনের উপায়েই সমাধান করা যায়। সমাধান করতে যদি কোনো ফর্মুলা চাওয়া হয় যারা এক্সপার্ট তারা তা দিতে পারবেন। আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকেও দিতে পারব। আমরা মনে করি রাজনৈতিক দলগুলো এবং যারা স্টেকহোল্ডার, যারা নির্বাচন করবেন, যারা নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন দেশীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে, তাদের পরামর্শ চাইলে ভালো হয়। আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা কার্যকর প্রক্রিয়া বের করতে পারি, যেটা আমার দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী হবে। এটি কঠিন কোনো কাজ নয় বরং কঠিন সেটাই, আমি ওইদিকে যাব কি না। কারণ আমি যদি এভাবে নির্বাচন হাতছাড়া করে দিই, তাহলে আমি নির্বাচনে হেরে যাব। আর নির্বাচনে হেরে গেলে আমার অবস্থা খারাপ হবে। এ মানসিকতা যদি থাকে তাহলে আমরা কোনোদিনই কোনো সমাধান করতে পারব না।
জাতীয় পার্টি কি গতবারের মতো নির্বাচনে যাবে নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না?
জি এম কাদের : নির্বাচনে যাওয়া বা না যাওয়া এটা নির্ভর করবে নির্বাচনের আগের পরিস্থিতির ওপর। আর একটা বিষয় আমরা গত কয়েকবার লক্ষ করেছি, নির্বাচন বর্জন করা কোনো সমাধান নয়। এর ফলে ভালো কোনো ফল আসে না। তবে এবারের পরিস্থিতি অবশ্যই আলাদা। এসব কিছু বিবেচনা করে সবকিছু বুঝেই আমরা কাজ করব। আমি শহীদ হলাম এবং তার ফলে কোনো কিছু লাভ হলো না, তাহলে সেই শহীদের কোনো দরকার নেই। আমার শহীদ হওয়ার ফলে যদি দেশের কোনো উপকার হয়, তাহলে মনে করা যায় এটা কার্যকর হলো।
গত নির্বাচনে আপনারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে ছিলেন। এবারও কি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করবেন?
জি এম কাদের : এখন পর্যন্ত আমরা স্বতন্ত্র নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা আমাদের নিজস্ব রাজনীতি ধরে রাখতে চাই। ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে আমরা মহাজোট করেছিলাম। ২০১৪ ও ’১৮ সালে যেটা হয়েছে, সেটা নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তখন মহাজোট করা হয়েছিল এবং ফলস্বরূপ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল এবং বিএনপি ক্ষমতা থেকে চলে গিয়েছিল। তখন আমাদেরও দরকার ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাওয়ার, তেমনিভাবে আওয়ামী লীগেরও দরকার ছিল আমাদের। সেই হিসেবে যাওয়া হয়েছিল।
সামনের নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তা দুটো জোটের মধ্যেই হবে। একটার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ দেবে, আরেকটার নেতৃত্ব বিএনপি দিতে পারে। অথবা অন্য কোনো শক্তিশালী দল যদি আসে তারা দেবে। তবে যেই ক্ষমতায় আসুক, দুটি জোটের মধ্যেই নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। আমরা কোন পজিশনে যাব বা কোথায় থাকব, সেটি পরিস্থিতি বুঝেই করতে হবে। আমরা এখন সেটি বলতে পারব না। নির্বাচনের আগে রাজনীতিক প্রেক্ষাপটে অনেক পরিবর্তন হতে পারে। এটার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই সেসব পরিস্থিতি না দেখে আগে থেকে আমি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে পারব না। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি এটা স্বাভাবিক। আমরা একটি জাতীয় পর্যায়ের দল। ৩০০ আসনেই আমাদের প্রার্থী আছে এবং আমরা ৩০০ আসনের জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে আমরা সিদ্ধান্ত নিব কী করতে হবে।
কোন জোটে যোগদান করবেন?
জি এম কাদের : এখন পর্যন্ত আমরা কোনো জোটে যাচ্ছি না। তবে বিষয়টি পরবর্তীকালে চিন্তাভাবনা করে দেখা যাবে। আন্দোলন যখন শুরু হবে তখন পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন কী হবে আমরা জানি না। এর আগে পর্যন্ত আন্দোলন সহিংসভাবে দমন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। সামরিক শাসনগুলোতেও আমরা এ ধরনের দমন-নিপীড়ন দেখিনি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের মতো দল আন্দোলনের সামনে গিয়ে কতটুকু ঠিক থাকতে পারবে, সেটা নিশ্চিত নয়। তাই যা কিছু করার, সেটা বুঝে করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নিয়ে আপনাদের প্রতিক্রিয়া কী?
জি এম কাদের : এটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি। তারা যেটি করছেন সেটি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে, দেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন এবং সমস্যা সমাধানের জন্য বিদেশিদের আমাদের ওপর চাপ দিতে হয়। আমরা নিজেরা এটা করি না। আমরা নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি না। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ওপর যখন অত্যাচার শুরু হলো, যখন তাদের সঠিকভাবে বেতন দেওয়া হতো না, তাদের কোনো ইউনিয়ন করার অধিকার ছিল না, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হতো, অনিরাপদ জায়গায় কাজ করতে হতো, তখন এসব বিষয় নিয়ে আমেরিকা এবং বিদেশিরা আমাদের অনেক চাপ দিয়েছে। আমি তখন মন্ত্রী ছিলাম। আমার জায়গা থেকে আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমি দেখলাম, সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টা ততটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। মালিকদের বাধ্য করা যাচ্ছে না। তখন তারা আমাদের জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দিল। আরও কিছু হুমকি দেওয়া হলো। বাংলাদেশ তখন অনেক ব্যবস্থা নিল। এটাকে আমরা ইন্টারফেয়ারেন্স বলি। কিন্তু এই ইন্টারফেয়ারেন্স দেশের জনগণের পক্ষে। ভিসা নীতিসহ যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা আমাদের দেশের জনগণের স্বার্থেই। এগুলো জনগণের পক্ষে যাচ্ছে।
তাই এগুলোকে আমি ইন্টারফেয়ারেন্স মনে করি না।
তারা তাদের সার্বভৌম ক্ষমতার মধ্য থেকে এসব কথা বলছে। তারা বলছে, আমরা তোমাদের দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। কারও তো বলা উচিত না যে আমি এটা চাই না। আমিও যদি সুষ্ঠু নির্বাচন চাই তাহলে আমার ভয়ের কী আছে? তারা যদি মনে করে আমি এখানে সুষ্ঠু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করছি, তাহলে তিনি তার দেশে আমাকে ঢুকতে দেবেন না। তার দেশে তিনি আমার জন্য একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন। এটা তার সার্বভৌম অধিকার। সরকার কি বলতে পারবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন চাওয়াটা অন্যায়? এটা ন্যায়সংগত। তাহলে এটাকে আমি ভয় পাচ্ছি কেন! এটাকে আমি ইন্টারফেয়ারেন্স বলছি কেন? তার মানে আমার ভয় আমি সুষ্ঠু নির্বাচন দেব না এবং সুষ্ঠু নির্বাচন না দিলে তারা তাদের দেশে আমার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে আমি স্বীকার করে নিচ্ছি যে, আমি কিছু অপরাধ করতে যাচ্ছি। আর তাদের এ কাজে আমার অপরাধ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিষয়গুলো সরকার সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারছে বলে মনে করেন কি?
জি এম কাদের :সরকার নার্ভাসনেস থেকে অনেক কথা বলছে। আমরা বিদেশে যাব কি যাব না, সেটা বড় কথা নয়। হয়তো আমরা কোনোদিনই যাব না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাকে যেতে দেওয়া হবে না অর্থাৎ আমাকে ব্ল্যাকলিস্টেড করা হবে। আমাকে শুধু নয়, আমার সন্তানদেরও যেতে দেওয়া হবে না। আমার পরিবারকে যেতে দেওয়া হবে না। এগুলো অসম্মানজনক বিষয়।
আমেরিকাকে আমাদের লাগবে না, এ বিষয়টাও ঠিক নয়। দেশে যারা বিভিন্নভাবে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত, যারা ব্যাপক পরিমাণ দুর্নীতি করেছেন, যারা প্রচুর পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন, তারা বেশিরভাগই তাদের ঠিকানা করেছেন পশ্চিমা বিশ্বে। অনেকে অর্থ সম্পদ অর্জন করেছেন, বাড়ি-গাড়ি করেছেন, তাদের পরিবার সেখানে নিয়ে গেছেন। কাজেই পশ্চিমা বিশ্ব থেকে যদি কোনো ধরনের চাপ আসে যে, তারা সেখানে যেতে পারবেন না বা তাদের সহায়-সম্পত্তির কোনো সমস্যা হবে, তাহলে তারা অবশ্যই সেটাকে সিরিয়াসলি নেবেন। আমরা সাধারণ মানুষ মনে করব যে, এটা আমাদের জন্য একটা অসম্মান কিন্তু তাদের জন্য এটা শুধু একটা অসম্মান না, অনেক ক্ষতিকরও হতে পারে। কাজেই বিষয়টা তাদের গায়ে বেশি লাগছে বলে তারা এসব অপকর্মে যুক্ত।
প্রথমত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা গণতন্ত্রের জন্য প্রবেশপথ। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে যে ক্ষমতায় আসে সে জানে পাঁচ বছর পর তাকে জবাবদিহিতার জন্য দাঁড়াতে হবে। এ বিষয়টি ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটাও উন্নত হবে।
সরকার কি সঠিক পথে এগোচ্ছে?
জি এম কাদের : সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে না বা করতে চাচ্ছে না। বিদেশি চাপগুলো নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ করতে সরকারকে বাধ্য করছে। আমরা ধরে নিচ্ছি যে, বিদেশিরা আমাদের থেকে কিছু একটা চাচ্ছে। সেটা দিলেই তারা আর নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাবে না। এ ধরনের প্রচারণাগুলো সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী বা সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে চাওয়াদের পক্ষ থেকে চলছে। আমি নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিদেশি চাপের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক কোনো সম্পর্ক দেখি না।
আমরা সরকারের সঙ্গে নেই। ২০০৮-এ আমরা অফিসিয়ালি মহাজোটে ছিলাম। এরপর আমরা মহাজোটেও ছিলাম না এবং এখনো আমরা সরকারের সঙ্গে নেই।