দুয়ারে কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। তারপরও বিভাগীয় শহর রাজশাহী অঞ্চলের সবেচেয় বড় পশুর হাট খ্যাত ‘সিটি হাট’ জমে উঠেনি। হাটে পর্যাপ্ত পশু থাকলেও কেনাবেচা নেই বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে টানা দুই বছর করোনা মহামারি কাটিয়ে এবার ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত কী হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এই অঞ্চলের খামারিরা।
তারা বলছেন, শেষ পর্যন্ত হাট জমবে কি না, প্রত্যাশিত লাভ করতে পারবেন কি না, সে দুশ্চিন্তায় কাটছে তাদের সময়। তারা ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ভরসা করতে পারছেন না। সব মিলিয়ে এখানকার খামারি ও পশু ব্যবসায়ীদের সময়টা ভালো যাচ্ছে না। হাটের অপেক্ষায় না থেকে অনেক খামারি মুঠোফোনের মাধ্যমে পরিচিতদের কাছে বার্তা প্রেরণ করেও পশু বিক্রির চেষ্টা করছেন।
স্থানীয় খামারিরা বলছেন, বাজারে গো-খাদ্যের দাম চড়া। বাধ্য হয়ে তাই বেশি দামে খাবার কিনে গবাদি পশুকে খাওয়ানো হচ্ছে। এতে পশু পালনের ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ। এ অবস্থায় হাটে বেশি দাম না পেলে লোকসান হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি বুঝে হাটে পশু তোলার সিদ্ধান্ত নেবেন উল্লেখ করে পুঠিয়া উপজেলার খামারি আশরাফুল বলেন, বর্তমানে পশু খাদ্যের অতিরিক্ত মূল্য। এছাড়া অন্যান্য খরচ মিলে গরু লালন-পালনে ব্যয় বেড়েছে। ফলে দাম পেলেই কেবল পশু হাটে তুলব। অন্যথায় হাটে নিয়ে অবিক্রিত হয়ে ফেরত এলে পরিবহনের অতিরিক্ত খরচ বেড়ে পশুর উৎপাদন মূল্য বৃদ্ধি হবে। ফলে লোকসানের পরিমাণও বাড়বে। যে কারণে প্রতিনিয়তই হাটের খবর রাখছি। এছাড়াও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারের মধ্যেই এবার সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক বন্যার কারণে কোরবানির পশুর দাম বেশি পাওয়া যাবে না বলেও মনে হচ্ছে।
বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য বলছে, নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চল পশু পালনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা করোনার দুই বছর আগেও ছিল না। তাই এটি রাজশাহীর একটি অনন্য সাফল্য। বর্তমানে দেশের মধ্যে কোরবানির জন্য সবচেয়ে বেশি ছাগল রয়েছে রাজশাহীতে। এছাড়া কোরবানির জন্য চাহিদার চেয়েও গরু বেশি রয়েছে।
দপ্তরটির তথ্য মতে, রাজশাহী বিভাগে ১ লাখ ৩০ হাজার ২৬৫ জন খামারি রয়েছেন। বর্তমানে এসব খামারিদের কাছে কোরবানির জন্য ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৯টি গরু, ২১ হাজার ৫২১টি মহিষ, ২৮ লাখ ২২ হাজার ৬৩৯টি ছাগল এবং ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৭টি ভেড়া রয়েছে। আর রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর বলছে, রাজশাহী জেলায় কোরবানির জন্য মোট পশু প্রস্তুত হয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৮৫২টি। এ জেলায় এবার সম্ভাব্য চাহিদা ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১৮টি। অর্থাৎ প্রায় ১০ হাজার গরু বেশি রয়েছে। রাজশাহী জেলার ৯ উপজেলায় ১৬ হাজার ৭৯ জন খামারি রয়েছেন। তাদের কাছে কোরবানির জন্য ১ লাখ ২১ হাজার ৩৭২টি গরু, ২ লাখ ৩৩ হাজার ২৩৫টি ছাগল, ৩৮ হাজার ২৪৫টি ভেড়া আছে। এছাড়া মহিষ রয়েছে ৩ হাজার ২১১টি। যা চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত রয়েছে।
রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কর্মকর্তা ডা. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, রাজশাহী জেলায় কোরবানির ঈদে দুই লাখ গবাদি পশুর প্রয়োজন পড়ে। বিপরীতে এবার প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোরবানির জন্য উপযুক্ত পশু উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু সেভাবে এখন পর্যন্ত বিক্রির জন্য সাড়া পড়েনি। তিনি বলেন, করোনা অতিমারির কারণে গেল দুই বছর রাজশাহীর খামারিদের অনেক লোকসান হয়েছে। এরপরও তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছেন। এ কারণে নানা সংকট মোকাবিলা করে কোরবানির জন্য পশু লালন-পালন করেছেন। যে কারণে এবার মোট চাহিদার চেয়েও প্রায় ১০ হাজার গরু বেশি রয়েছে। ফলে দেশি গরু দিয়েই এবার কোরবানির চাহিদা পূরণ সম্ভব। প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পরামর্শ নিয়ে খামারিরা স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে মোটাতাজা করা হয়েছে বলে এগুলো অনেক বেশি নিরাপদ।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এবার তেমন করোনার সংক্রমণ না থাকায় ভালো দাম পাবেন বলে আশা করছি। তবে বাজার মন্দার বিষয়টাও সবাইকে ভাবাচ্ছে। এরপরও হাটে কেনাবেচা জমে উঠলে খামারিরা লাভের মুখ দেখতে পারবেন। তবে গবাদি পশু লালন-পালনে খরচ বাড়ায় এবার কোরবানির পশুর দামও কিছুটা বেশি হতে পারে।
এক সমীক্ষায় জানা গেছে, গত দুই বছর ধরে করোনার কারণে আর্থিক সংকটে রয়েছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। যারা সাধারণত একাধিক ভাগে কোরবানি দিয়ে থাকেন। এছাড়াও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারের মধ্যেই এবার সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক বন্যার কারণে ওই অঞ্চলের মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলেও এবার অনেকেই কোরবানি দিতে পারা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। এছাড়াও ঊর্ধ্বগতির বাজারসহ বিভিন্ন কারণে এবার কোরবানির পশু বিক্রি কম হচ্ছে। সবমিলিয়ে কোরবানির জন্য পশুর দাম বেশি পাওয়া যাবে না বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে গতকাল রাজশাহী সিটি হাটে দেখা যায়, মাস্ক ছাড়া ক্রেতা-বিক্রেতার হাটে প্রবেশ নিষেধ থাকার বিষয়ে কোনো তদারকি লক্ষ্য করা যায়নি। হাটের প্রবেশ মুখে শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণকারী যন্ত্রের ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছে সচেতন সমাজ।
খামারি ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, হাটে ১২টি গরু নিয়ে এলেও চারটি বিক্রি করতে পেরেছেন। এ কারণে তিনি তেমন খুশি নন। তিনি বলেন, শুনছি আবার করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। এর মধ্যে বন্যায় ভাসছে দেশের সিলেট অঞ্চল। ওই এলাকার ব্যাপারীদের এখন পর্যন্ত রাজশাহীর সিটি হাটে দেখা মেলেনি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে ওই এলাকার বন্যার প্রভাব আমাদের হাটে পড়েছে। তবে ঢাকাসহ অন্য বিভাগের ব্যাপারীরা হাটে আসতে শুরু করেছেন। তারা বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। এছাড়া এলাকাভিত্তিক কোরবানির ভাগা দেওয়া মানুষগুলোও এখনো ঠিকঠাক হাটে আসছেন না। তবে আগামী দিনগুলোতে তারা আসলে কেনাবেচা জমতে পারে বলে ধারণা করছি।
এ বিষয়ে ‘সিটি হাট’ ইজারাদার আতিকুর রহমান কালু রবিবার বিকালে বলেন, মাস্ক পরার জন্য সার্বক্ষণিক বললেও সবাই মানতে চাচ্ছেন না। ভারতীয় পশু আমদানি বন্ধ থাকায় এবারও হাটে শুধু দেশি গরু রয়েছে। কিন্তু বেচাকেনা খুবই খারাপ। শেষ সময়েও হাট জমছে না। ফলে সবাই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, করোনার প্রভাব, ঊর্ধ্বমুখী বাজার ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখান থেকে এবার সিলেট অঞ্চলে কোরবানির জন্য পশু যায়নি।
সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে কালু বলেন, হাটে তো কেনাবেচাই নাই। তারপরও যতটুকু হচ্ছে লেনদেনের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত জাল টাকা বা কোনো জালিয়াতি চক্রের খপ্পরে কেউ পড়েনি। তিনি বলেন, লেনেদেনের জন্য সিটি হাটে বিভিন্ন ব্যাংকের পক্ষ থেকে জাল টাকা শনাক্তকরণ মেশিন বসানো ছাড়াও প্রশাসনের কঠোর নজরদারি রয়েছে।