সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৯ শতাংশের বেশি। একটু বাড়িয়ে যদি ৩০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়, তাহলে জনমিতিক হিস্যায় তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য এ এক বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি কিংবা নীতিনির্ধারণে তরুণেরা কোথাও কি আছেন?
একটা রূঢ় বাস্তবতা হলো, এখন যাঁদের বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে, তাঁরা ভোটার হওয়ার পর দেশে ভোট–উৎসব দেখেনি। অথচ পিউ রিসার্চের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা সংস্থার জরিপ বলছে, রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষেরা বিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে। দেশে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। সে সময়ে আজকের তরুণদের অনেকের সবে শৈশব। এর পরের দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় উৎসবের আবহ তাতে ছিল না। ভোটার হওয়ার পর প্রথম ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতাটাই তাঁদের অনেকের হয়নি।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে।
আইনজীবী, রাজনীতিক, শ্রমিকনেতা ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমদ পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনৈতিক পরিসরে পরিচিত মুখ। এ দেশের সমাজ, রাজনীতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের চালচিত্র পাওয়া যায় তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায়। ষাটের দশকে এ দেশের তরুণদের জাগরণের সঙ্গে ফ্রান্সের তরুণদের তুলনা করেছিলেন তিনি। ফরাসি বিদ্রোহের আগে থেকেই ফ্রান্সের তরুণেরা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহী।
সেই পরম্পরার প্রতিফলন আমরা আজও দেখছি। আলজেরিয়ার বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী কিশোর নাহেলকে হত্যার ঘটনায় ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। ষাটের দশকে সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসি তরুণদের বিদ্রোহে। শুধু ফ্রান্সের শিক্ষা অঙ্গনে নয়; শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলাতেও সেই অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে সমাজের সব অংশই শামিল হয়েছিল। তাতে নারী স্বাধীনতা, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ফ্রান্সের সমাজে বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছিল।
এর সমান্তরালে ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্র-তরুণদের বিদ্রোহের প্রভাব ছিল আরও গভীর। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশের জন্ম হওয়াটা সম্ভব হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় তরুণদের বিদ্রোহের কারণেই। রাজনীতিতে তরুণদের এই বিদ্রোহের জানান দেওয়া হয়ে গিয়েছিল দুই দশক আগেই—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে।
যে তরুণেরা পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই তাঁরাই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের। একইভাবে ১৯৬৮,১৯৬৯, ১৯৭০,১৯৭১ সালে তরুণ নেতৃত্ব সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলেই স্বাধীনতার দাবি পরিণতি পেয়েছিল। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় ছাত্র-তরুণেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, সামরিক শাসনের সময়ে যা হয়নি, সংসদীয় ধারার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে সেই কাজই হয়েছে। তরুণদের রাজনীতিতে উঠে আসার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী চার দশকে এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের জন্মকেন্দ্র বলে পরিচিত ডাকসুসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদকে পুরোপুরি অকেজো করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি বাম সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও তরুণদের রাজনীতিতে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এখন ষাট, সত্তর ও আশির প্রজন্মের বাইরে কেউ নেই বললেই চলে। হাতে গোনা যাঁরাও আসছেন, তাঁরা নিজেরা উঠে আসছেন, সেটা বলা যাবে না; বরং নেপিটজম অর্থাৎ বাবা-চাচা-মামা-খালার বদৌলতে এবং অর্থ ও ক্ষমতার ভারে।
এ তো গেল নেতৃত্বের জায়গা। ভোটারের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন? নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রত্যেক ভোটারের আওয়াজ সমান। পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে তাঁরা তাদের সেই আওয়াজের বাস্তবায়ন ঘটানোর সুযোগ পান। কিন্তু এটা তো কেতাবি কথা। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার যে শব্দগুলো বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, নিশ্চিতভাবেই এর শীর্ষে থাকবে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘নির্বাচন’। এ দুটি এখন অনেকটাই অভিধানের শব্দ। বাস্তবে তার অস্তিত্ব কোথায়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফল এখন সমাজে দেখছি।’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ডাকসুর উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নাটক, বিতর্ক, সংগীত, সাহিত্য, খেলাধুলা মাধ্যমে সজীব ও প্রাণবন্ত ছিল।
যে তরুণেরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছেন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, সেই তরুণদের প্রতি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো কি সঠিক দায়িত্বটা পালন করেছে।
ভিন্নমতাদর্শের হলেও তাঁরা একসঙ্গে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—এসব আদর্শকে সামনে রেখে কাজ করেছেন। আজকের মতো এমন মেরুকরণ তখন তো দেখা যায়নি। বিদ্বেষ, ঘৃণায় একে অন্যকে তাঁরা কেউ কাউকে হাওয়া করে দিতে চাননি।
সবাই আশা করেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসায় ছাত্র-তরুণদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ আরও প্রসারিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ আরও মুক্ত ও উদার হবে। কিন্তু উল্টো তাঁরাই আক্রান্ত হলেন। সংকুচিত হয়ে গেল তাঁদের পরিসর। ডাকসুসহ সমস্ত ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। চর দখলের মতো করে ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিতে শুরু করে। তারা মনে করতে শুরু করল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলেই সমাজের অন্য অংশকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশ এখন আরেকটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখা যাচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক ক্ষেত্র। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ইরান অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলছে।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে। রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দেওয়ায় সেটা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ি গেছে। সমাজ, অর্থনীতি, বৈষম্য, কর্মসংস্থান, নৈতিকতা সবখানেই এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
সমাজ-রাজনীতির নেতৃত্বে তরুণেরা আবার কর্তারূপে বা চালিকা শক্তি হিসেবে ফিরতে না পারলে, বাংলাদেশের স্বজনতোষী ও গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর রাজনীতি-অর্থনীতির কি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসবে? রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দিয়ে দেওয়ার ফল আমরা কবে বুঝতে পারব।
সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৯ শতাংশের বেশি। একটু বাড়িয়ে যদি ৩০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়, তাহলে জনমিতিক হিস্যায় তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য এ এক বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি কিংবা নীতিনির্ধারণে তরুণেরা কোথাও কি আছেন?
একটা রূঢ় বাস্তবতা হলো, এখন যাঁদের বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে, তাঁরা ভোটার হওয়ার পর দেশে ভোট–উৎসব দেখেনি। অথচ পিউ রিসার্চের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা সংস্থার জরিপ বলছে, রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষেরা বিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে। দেশে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। সে সময়ে আজকের তরুণদের অনেকের সবে শৈশব। এর পরের দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় উৎসবের আবহ তাতে ছিল না। ভোটার হওয়ার পর প্রথম ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতাটাই তাঁদের অনেকের হয়নি।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে।
আইনজীবী, রাজনীতিক, শ্রমিকনেতা ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমদ পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনৈতিক পরিসরে পরিচিত মুখ। এ দেশের সমাজ, রাজনীতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের চালচিত্র পাওয়া যায় তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায়। ষাটের দশকে এ দেশের তরুণদের জাগরণের সঙ্গে ফ্রান্সের তরুণদের তুলনা করেছিলেন তিনি। ফরাসি বিদ্রোহের আগে থেকেই ফ্রান্সের তরুণেরা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহী।
সেই পরম্পরার প্রতিফলন আমরা আজও দেখছি। আলজেরিয়ার বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী কিশোর নাহেলকে হত্যার ঘটনায় ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। ষাটের দশকে সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসি তরুণদের বিদ্রোহে। শুধু ফ্রান্সের শিক্ষা অঙ্গনে নয়; শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলাতেও সেই অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে সমাজের সব অংশই শামিল হয়েছিল। তাতে নারী স্বাধীনতা, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ফ্রান্সের সমাজে বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছিল।
এর সমান্তরালে ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্র-তরুণদের বিদ্রোহের প্রভাব ছিল আরও গভীর। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশের জন্ম হওয়াটা সম্ভব হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় তরুণদের বিদ্রোহের কারণেই। রাজনীতিতে তরুণদের এই বিদ্রোহের জানান দেওয়া হয়ে গিয়েছিল দুই দশক আগেই—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে।
যে তরুণেরা পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই তাঁরাই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের। একইভাবে ১৯৬৮,১৯৬৯, ১৯৭০,১৯৭১ সালে তরুণ নেতৃত্ব সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলেই স্বাধীনতার দাবি পরিণতি পেয়েছিল। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় ছাত্র-তরুণেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, সামরিক শাসনের সময়ে যা হয়নি, সংসদীয় ধারার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে সেই কাজই হয়েছে। তরুণদের রাজনীতিতে উঠে আসার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী চার দশকে এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের জন্মকেন্দ্র বলে পরিচিত ডাকসুসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদকে পুরোপুরি অকেজো করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি বাম সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও তরুণদের রাজনীতিতে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এখন ষাট, সত্তর ও আশির প্রজন্মের বাইরে কেউ নেই বললেই চলে। হাতে গোনা যাঁরাও আসছেন, তাঁরা নিজেরা উঠে আসছেন, সেটা বলা যাবে না; বরং নেপিটজম অর্থাৎ বাবা-চাচা-মামা-খালার বদৌলতে এবং অর্থ ও ক্ষমতার ভারে।
এ তো গেল নেতৃত্বের জায়গা। ভোটারের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন? নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রত্যেক ভোটারের আওয়াজ সমান। পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে তাঁরা তাদের সেই আওয়াজের বাস্তবায়ন ঘটানোর সুযোগ পান। কিন্তু এটা তো কেতাবি কথা। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার যে শব্দগুলো বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, নিশ্চিতভাবেই এর শীর্ষে থাকবে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘নির্বাচন’। এ দুটি এখন অনেকটাই অভিধানের শব্দ। বাস্তবে তার অস্তিত্ব কোথায়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফল এখন সমাজে দেখছি।’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ডাকসুর উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নাটক, বিতর্ক, সংগীত, সাহিত্য, খেলাধুলা মাধ্যমে সজীব ও প্রাণবন্ত ছিল।
যে তরুণেরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছেন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, সেই তরুণদের প্রতি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো কি সঠিক দায়িত্বটা পালন করেছে।
ভিন্নমতাদর্শের হলেও তাঁরা একসঙ্গে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—এসব আদর্শকে সামনে রেখে কাজ করেছেন। আজকের মতো এমন মেরুকরণ তখন তো দেখা যায়নি। বিদ্বেষ, ঘৃণায় একে অন্যকে তাঁরা কেউ কাউকে হাওয়া করে দিতে চাননি।
সবাই আশা করেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসায় ছাত্র-তরুণদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ আরও প্রসারিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ আরও মুক্ত ও উদার হবে। কিন্তু উল্টো তাঁরাই আক্রান্ত হলেন। সংকুচিত হয়ে গেল তাঁদের পরিসর। ডাকসুসহ সমস্ত ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। চর দখলের মতো করে ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিতে শুরু করে। তারা মনে করতে শুরু করল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলেই সমাজের অন্য অংশকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশ এখন আরেকটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখা যাচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক ক্ষেত্র। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ইরান অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলছে।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে। রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দেওয়ায় সেটা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ি গেছে। সমাজ, অর্থনীতি, বৈষম্য, কর্মসংস্থান, নৈতিকতা সবখানেই এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
সমাজ-রাজনীতির নেতৃত্বে তরুণেরা আবার কর্তারূপে বা চালিকা শক্তি হিসেবে ফিরতে না পারলে, বাংলাদেশের স্বজনতোষী ও গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর রাজনীতি-অর্থনীতির কি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসবে? রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দিয়ে দেওয়ার ফল আমরা কবে বুঝতে পারব।
সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৯ শতাংশের বেশি। একটু বাড়িয়ে যদি ৩০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়, তাহলে জনমিতিক হিস্যায় তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য এ এক বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি কিংবা নীতিনির্ধারণে তরুণেরা কোথাও কি আছেন?
একটা রূঢ় বাস্তবতা হলো, এখন যাঁদের বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে, তাঁরা ভোটার হওয়ার পর দেশে ভোট–উৎসব দেখেনি। অথচ পিউ রিসার্চের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা সংস্থার জরিপ বলছে, রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষেরা বিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে। দেশে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। সে সময়ে আজকের তরুণদের অনেকের সবে শৈশব। এর পরের দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় উৎসবের আবহ তাতে ছিল না। ভোটার হওয়ার পর প্রথম ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতাটাই তাঁদের অনেকের হয়নি।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে।
আইনজীবী, রাজনীতিক, শ্রমিকনেতা ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমদ পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনৈতিক পরিসরে পরিচিত মুখ। এ দেশের সমাজ, রাজনীতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের চালচিত্র পাওয়া যায় তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায়। ষাটের দশকে এ দেশের তরুণদের জাগরণের সঙ্গে ফ্রান্সের তরুণদের তুলনা করেছিলেন তিনি। ফরাসি বিদ্রোহের আগে থেকেই ফ্রান্সের তরুণেরা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহী।
সেই পরম্পরার প্রতিফলন আমরা আজও দেখছি। আলজেরিয়ার বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী কিশোর নাহেলকে হত্যার ঘটনায় ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। ষাটের দশকে সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসি তরুণদের বিদ্রোহে। শুধু ফ্রান্সের শিক্ষা অঙ্গনে নয়; শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলাতেও সেই অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে সমাজের সব অংশই শামিল হয়েছিল। তাতে নারী স্বাধীনতা, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ফ্রান্সের সমাজে বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছিল।
এর সমান্তরালে ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্র-তরুণদের বিদ্রোহের প্রভাব ছিল আরও গভীর। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশের জন্ম হওয়াটা সম্ভব হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় তরুণদের বিদ্রোহের কারণেই। রাজনীতিতে তরুণদের এই বিদ্রোহের জানান দেওয়া হয়ে গিয়েছিল দুই দশক আগেই—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে।
যে তরুণেরা পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই তাঁরাই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের। একইভাবে ১৯৬৮,১৯৬৯, ১৯৭০,১৯৭১ সালে তরুণ নেতৃত্ব সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলেই স্বাধীনতার দাবি পরিণতি পেয়েছিল। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় ছাত্র-তরুণেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, সামরিক শাসনের সময়ে যা হয়নি, সংসদীয় ধারার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে সেই কাজই হয়েছে। তরুণদের রাজনীতিতে উঠে আসার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী চার দশকে এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের জন্মকেন্দ্র বলে পরিচিত ডাকসুসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদকে পুরোপুরি অকেজো করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি বাম সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও তরুণদের রাজনীতিতে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এখন ষাট, সত্তর ও আশির প্রজন্মের বাইরে কেউ নেই বললেই চলে। হাতে গোনা যাঁরাও আসছেন, তাঁরা নিজেরা উঠে আসছেন, সেটা বলা যাবে না; বরং নেপিটজম অর্থাৎ বাবা-চাচা-মামা-খালার বদৌলতে এবং অর্থ ও ক্ষমতার ভারে।
এ তো গেল নেতৃত্বের জায়গা। ভোটারের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন? নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রত্যেক ভোটারের আওয়াজ সমান। পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে তাঁরা তাদের সেই আওয়াজের বাস্তবায়ন ঘটানোর সুযোগ পান। কিন্তু এটা তো কেতাবি কথা। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার যে শব্দগুলো বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, নিশ্চিতভাবেই এর শীর্ষে থাকবে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘নির্বাচন’। এ দুটি এখন অনেকটাই অভিধানের শব্দ। বাস্তবে তার অস্তিত্ব কোথায়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফল এখন সমাজে দেখছি।’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ডাকসুর উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নাটক, বিতর্ক, সংগীত, সাহিত্য, খেলাধুলা মাধ্যমে সজীব ও প্রাণবন্ত ছিল।
যে তরুণেরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছেন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, সেই তরুণদের প্রতি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো কি সঠিক দায়িত্বটা পালন করেছে।
ভিন্নমতাদর্শের হলেও তাঁরা একসঙ্গে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—এসব আদর্শকে সামনে রেখে কাজ করেছেন। আজকের মতো এমন মেরুকরণ তখন তো দেখা যায়নি। বিদ্বেষ, ঘৃণায় একে অন্যকে তাঁরা কেউ কাউকে হাওয়া করে দিতে চাননি।
সবাই আশা করেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসায় ছাত্র-তরুণদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ আরও প্রসারিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ আরও মুক্ত ও উদার হবে। কিন্তু উল্টো তাঁরাই আক্রান্ত হলেন। সংকুচিত হয়ে গেল তাঁদের পরিসর। ডাকসুসহ সমস্ত ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। চর দখলের মতো করে ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিতে শুরু করে। তারা মনে করতে শুরু করল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলেই সমাজের অন্য অংশকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশ এখন আরেকটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখা যাচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক ক্ষেত্র। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ইরান অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলছে।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে। রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দেওয়ায় সেটা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ি গেছে। সমাজ, অর্থনীতি, বৈষম্য, কর্মসংস্থান, নৈতিকতা সবখানেই এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
সমাজ-রাজনীতির নেতৃত্বে তরুণেরা আবার কর্তারূপে বা চালিকা শক্তি হিসেবে ফিরতে না পারলে, বাংলাদেশের স্বজনতোষী ও গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর রাজনীতি-অর্থনীতির কি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসবে? রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দিয়ে দেওয়ার ফল আমরা কবে বুঝতে পারব।
সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৯ শতাংশের বেশি। একটু বাড়িয়ে যদি ৩০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়, তাহলে জনমিতিক হিস্যায় তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য এ এক বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি কিংবা নীতিনির্ধারণে তরুণেরা কোথাও কি আছেন?
একটা রূঢ় বাস্তবতা হলো, এখন যাঁদের বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে, তাঁরা ভোটার হওয়ার পর দেশে ভোট–উৎসব দেখেনি। অথচ পিউ রিসার্চের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা সংস্থার জরিপ বলছে, রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষেরা বিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে। দেশে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। সে সময়ে আজকের তরুণদের অনেকের সবে শৈশব। এর পরের দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় উৎসবের আবহ তাতে ছিল না। ভোটার হওয়ার পর প্রথম ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতাটাই তাঁদের অনেকের হয়নি।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে।
আইনজীবী, রাজনীতিক, শ্রমিকনেতা ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমদ পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনৈতিক পরিসরে পরিচিত মুখ। এ দেশের সমাজ, রাজনীতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের চালচিত্র পাওয়া যায় তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায়। ষাটের দশকে এ দেশের তরুণদের জাগরণের সঙ্গে ফ্রান্সের তরুণদের তুলনা করেছিলেন তিনি। ফরাসি বিদ্রোহের আগে থেকেই ফ্রান্সের তরুণেরা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহী।
সেই পরম্পরার প্রতিফলন আমরা আজও দেখছি। আলজেরিয়ার বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী কিশোর নাহেলকে হত্যার ঘটনায় ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। ষাটের দশকে সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসি তরুণদের বিদ্রোহে। শুধু ফ্রান্সের শিক্ষা অঙ্গনে নয়; শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলাতেও সেই অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে সমাজের সব অংশই শামিল হয়েছিল। তাতে নারী স্বাধীনতা, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ফ্রান্সের সমাজে বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছিল।
এর সমান্তরালে ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্র-তরুণদের বিদ্রোহের প্রভাব ছিল আরও গভীর। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশের জন্ম হওয়াটা সম্ভব হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় তরুণদের বিদ্রোহের কারণেই। রাজনীতিতে তরুণদের এই বিদ্রোহের জানান দেওয়া হয়ে গিয়েছিল দুই দশক আগেই—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে।
যে তরুণেরা পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই তাঁরাই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের। একইভাবে ১৯৬৮,১৯৬৯, ১৯৭০,১৯৭১ সালে তরুণ নেতৃত্ব সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলেই স্বাধীনতার দাবি পরিণতি পেয়েছিল। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় ছাত্র-তরুণেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, সামরিক শাসনের সময়ে যা হয়নি, সংসদীয় ধারার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে সেই কাজই হয়েছে। তরুণদের রাজনীতিতে উঠে আসার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী চার দশকে এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের জন্মকেন্দ্র বলে পরিচিত ডাকসুসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদকে পুরোপুরি অকেজো করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি বাম সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও তরুণদের রাজনীতিতে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এখন ষাট, সত্তর ও আশির প্রজন্মের বাইরে কেউ নেই বললেই চলে। হাতে গোনা যাঁরাও আসছেন, তাঁরা নিজেরা উঠে আসছেন, সেটা বলা যাবে না; বরং নেপিটজম অর্থাৎ বাবা-চাচা-মামা-খালার বদৌলতে এবং অর্থ ও ক্ষমতার ভারে।
এ তো গেল নেতৃত্বের জায়গা। ভোটারের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন? নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রত্যেক ভোটারের আওয়াজ সমান। পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে তাঁরা তাদের সেই আওয়াজের বাস্তবায়ন ঘটানোর সুযোগ পান। কিন্তু এটা তো কেতাবি কথা। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার যে শব্দগুলো বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, নিশ্চিতভাবেই এর শীর্ষে থাকবে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘নির্বাচন’। এ দুটি এখন অনেকটাই অভিধানের শব্দ। বাস্তবে তার অস্তিত্ব কোথায়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফল এখন সমাজে দেখছি।’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ডাকসুর উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নাটক, বিতর্ক, সংগীত, সাহিত্য, খেলাধুলা মাধ্যমে সজীব ও প্রাণবন্ত ছিল।
যে তরুণেরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছেন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, সেই তরুণদের প্রতি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো কি সঠিক দায়িত্বটা পালন করেছে।
ভিন্নমতাদর্শের হলেও তাঁরা একসঙ্গে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—এসব আদর্শকে সামনে রেখে কাজ করেছেন। আজকের মতো এমন মেরুকরণ তখন তো দেখা যায়নি। বিদ্বেষ, ঘৃণায় একে অন্যকে তাঁরা কেউ কাউকে হাওয়া করে দিতে চাননি।
সবাই আশা করেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসায় ছাত্র-তরুণদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ আরও প্রসারিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ আরও মুক্ত ও উদার হবে। কিন্তু উল্টো তাঁরাই আক্রান্ত হলেন। সংকুচিত হয়ে গেল তাঁদের পরিসর। ডাকসুসহ সমস্ত ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। চর দখলের মতো করে ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিতে শুরু করে। তারা মনে করতে শুরু করল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলেই সমাজের অন্য অংশকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশ এখন আরেকটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখা যাচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক ক্ষেত্র। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ইরান অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলছে।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে। রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দেওয়ায় সেটা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ি গেছে। সমাজ, অর্থনীতি, বৈষম্য, কর্মসংস্থান, নৈতিকতা সবখানেই এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
সমাজ-রাজনীতির নেতৃত্বে তরুণেরা আবার কর্তারূপে বা চালিকা শক্তি হিসেবে ফিরতে না পারলে, বাংলাদেশের স্বজনতোষী ও গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর রাজনীতি-অর্থনীতির কি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসবে? রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দিয়ে দেওয়ার ফল আমরা কবে বুঝতে পারব।
সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৯ শতাংশের বেশি। একটু বাড়িয়ে যদি ৩০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়, তাহলে জনমিতিক হিস্যায় তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য এ এক বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি কিংবা নীতিনির্ধারণে তরুণেরা কোথাও কি আছেন?
একটা রূঢ় বাস্তবতা হলো, এখন যাঁদের বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে, তাঁরা ভোটার হওয়ার পর দেশে ভোট–উৎসব দেখেনি। অথচ পিউ রিসার্চের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা সংস্থার জরিপ বলছে, রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষেরা বিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে। দেশে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। সে সময়ে আজকের তরুণদের অনেকের সবে শৈশব। এর পরের দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় উৎসবের আবহ তাতে ছিল না। ভোটার হওয়ার পর প্রথম ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতাটাই তাঁদের অনেকের হয়নি।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে।
আইনজীবী, রাজনীতিক, শ্রমিকনেতা ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমদ পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনৈতিক পরিসরে পরিচিত মুখ। এ দেশের সমাজ, রাজনীতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের চালচিত্র পাওয়া যায় তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায়। ষাটের দশকে এ দেশের তরুণদের জাগরণের সঙ্গে ফ্রান্সের তরুণদের তুলনা করেছিলেন তিনি। ফরাসি বিদ্রোহের আগে থেকেই ফ্রান্সের তরুণেরা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহী।
সেই পরম্পরার প্রতিফলন আমরা আজও দেখছি। আলজেরিয়ার বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী কিশোর নাহেলকে হত্যার ঘটনায় ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। ষাটের দশকে সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসি তরুণদের বিদ্রোহে। শুধু ফ্রান্সের শিক্ষা অঙ্গনে নয়; শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলাতেও সেই অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে সমাজের সব অংশই শামিল হয়েছিল। তাতে নারী স্বাধীনতা, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ফ্রান্সের সমাজে বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছিল।
এর সমান্তরালে ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্র-তরুণদের বিদ্রোহের প্রভাব ছিল আরও গভীর। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশের জন্ম হওয়াটা সম্ভব হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় তরুণদের বিদ্রোহের কারণেই। রাজনীতিতে তরুণদের এই বিদ্রোহের জানান দেওয়া হয়ে গিয়েছিল দুই দশক আগেই—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে।
যে তরুণেরা পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই তাঁরাই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের। একইভাবে ১৯৬৮,১৯৬৯, ১৯৭০,১৯৭১ সালে তরুণ নেতৃত্ব সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলেই স্বাধীনতার দাবি পরিণতি পেয়েছিল। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় ছাত্র-তরুণেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, সামরিক শাসনের সময়ে যা হয়নি, সংসদীয় ধারার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে সেই কাজই হয়েছে। তরুণদের রাজনীতিতে উঠে আসার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী চার দশকে এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের জন্মকেন্দ্র বলে পরিচিত ডাকসুসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদকে পুরোপুরি অকেজো করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি বাম সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও তরুণদের রাজনীতিতে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এখন ষাট, সত্তর ও আশির প্রজন্মের বাইরে কেউ নেই বললেই চলে। হাতে গোনা যাঁরাও আসছেন, তাঁরা নিজেরা উঠে আসছেন, সেটা বলা যাবে না; বরং নেপিটজম অর্থাৎ বাবা-চাচা-মামা-খালার বদৌলতে এবং অর্থ ও ক্ষমতার ভারে।
এ তো গেল নেতৃত্বের জায়গা। ভোটারের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন? নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রত্যেক ভোটারের আওয়াজ সমান। পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে তাঁরা তাদের সেই আওয়াজের বাস্তবায়ন ঘটানোর সুযোগ পান। কিন্তু এটা তো কেতাবি কথা। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার যে শব্দগুলো বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, নিশ্চিতভাবেই এর শীর্ষে থাকবে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘নির্বাচন’। এ দুটি এখন অনেকটাই অভিধানের শব্দ। বাস্তবে তার অস্তিত্ব কোথায়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফল এখন সমাজে দেখছি।’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ডাকসুর উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নাটক, বিতর্ক, সংগীত, সাহিত্য, খেলাধুলা মাধ্যমে সজীব ও প্রাণবন্ত ছিল।
যে তরুণেরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছেন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, সেই তরুণদের প্রতি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো কি সঠিক দায়িত্বটা পালন করেছে।
ভিন্নমতাদর্শের হলেও তাঁরা একসঙ্গে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—এসব আদর্শকে সামনে রেখে কাজ করেছেন। আজকের মতো এমন মেরুকরণ তখন তো দেখা যায়নি। বিদ্বেষ, ঘৃণায় একে অন্যকে তাঁরা কেউ কাউকে হাওয়া করে দিতে চাননি।
সবাই আশা করেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসায় ছাত্র-তরুণদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ আরও প্রসারিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ আরও মুক্ত ও উদার হবে। কিন্তু উল্টো তাঁরাই আক্রান্ত হলেন। সংকুচিত হয়ে গেল তাঁদের পরিসর। ডাকসুসহ সমস্ত ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। চর দখলের মতো করে ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিতে শুরু করে। তারা মনে করতে শুরু করল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলেই সমাজের অন্য অংশকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশ এখন আরেকটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখা যাচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক ক্ষেত্র। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ইরান অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলছে।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে। রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দেওয়ায় সেটা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ি গেছে। সমাজ, অর্থনীতি, বৈষম্য, কর্মসংস্থান, নৈতিকতা সবখানেই এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
সমাজ-রাজনীতির নেতৃত্বে তরুণেরা আবার কর্তারূপে বা চালিকা শক্তি হিসেবে ফিরতে না পারলে, বাংলাদেশের স্বজনতোষী ও গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর রাজনীতি-অর্থনীতির কি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসবে? রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দিয়ে দেওয়ার ফল আমরা কবে বুঝতে পারব।
সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৯ শতাংশের বেশি। একটু বাড়িয়ে যদি ৩০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়, তাহলে জনমিতিক হিস্যায় তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য এ এক বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি কিংবা নীতিনির্ধারণে তরুণেরা কোথাও কি আছেন?
একটা রূঢ় বাস্তবতা হলো, এখন যাঁদের বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে, তাঁরা ভোটার হওয়ার পর দেশে ভোট–উৎসব দেখেনি। অথচ পিউ রিসার্চের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা সংস্থার জরিপ বলছে, রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষেরা বিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে। দেশে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। সে সময়ে আজকের তরুণদের অনেকের সবে শৈশব। এর পরের দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় উৎসবের আবহ তাতে ছিল না। ভোটার হওয়ার পর প্রথম ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতাটাই তাঁদের অনেকের হয়নি।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে।
আইনজীবী, রাজনীতিক, শ্রমিকনেতা ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমদ পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনৈতিক পরিসরে পরিচিত মুখ। এ দেশের সমাজ, রাজনীতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের চালচিত্র পাওয়া যায় তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায়। ষাটের দশকে এ দেশের তরুণদের জাগরণের সঙ্গে ফ্রান্সের তরুণদের তুলনা করেছিলেন তিনি। ফরাসি বিদ্রোহের আগে থেকেই ফ্রান্সের তরুণেরা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহী।
সেই পরম্পরার প্রতিফলন আমরা আজও দেখছি। আলজেরিয়ার বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী কিশোর নাহেলকে হত্যার ঘটনায় ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। ষাটের দশকে সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসি তরুণদের বিদ্রোহে। শুধু ফ্রান্সের শিক্ষা অঙ্গনে নয়; শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলাতেও সেই অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে সমাজের সব অংশই শামিল হয়েছিল। তাতে নারী স্বাধীনতা, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ফ্রান্সের সমাজে বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছিল।
এর সমান্তরালে ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্র-তরুণদের বিদ্রোহের প্রভাব ছিল আরও গভীর। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশের জন্ম হওয়াটা সম্ভব হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় তরুণদের বিদ্রোহের কারণেই। রাজনীতিতে তরুণদের এই বিদ্রোহের জানান দেওয়া হয়ে গিয়েছিল দুই দশক আগেই—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে।
যে তরুণেরা পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই তাঁরাই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের। একইভাবে ১৯৬৮,১৯৬৯, ১৯৭০,১৯৭১ সালে তরুণ নেতৃত্ব সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলেই স্বাধীনতার দাবি পরিণতি পেয়েছিল। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় ছাত্র-তরুণেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, সামরিক শাসনের সময়ে যা হয়নি, সংসদীয় ধারার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে সেই কাজই হয়েছে। তরুণদের রাজনীতিতে উঠে আসার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী চার দশকে এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের জন্মকেন্দ্র বলে পরিচিত ডাকসুসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদকে পুরোপুরি অকেজো করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি বাম সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও তরুণদের রাজনীতিতে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এখন ষাট, সত্তর ও আশির প্রজন্মের বাইরে কেউ নেই বললেই চলে। হাতে গোনা যাঁরাও আসছেন, তাঁরা নিজেরা উঠে আসছেন, সেটা বলা যাবে না; বরং নেপিটজম অর্থাৎ বাবা-চাচা-মামা-খালার বদৌলতে এবং অর্থ ও ক্ষমতার ভারে।
এ তো গেল নেতৃত্বের জায়গা। ভোটারের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন? নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রত্যেক ভোটারের আওয়াজ সমান। পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে তাঁরা তাদের সেই আওয়াজের বাস্তবায়ন ঘটানোর সুযোগ পান। কিন্তু এটা তো কেতাবি কথা। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার যে শব্দগুলো বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, নিশ্চিতভাবেই এর শীর্ষে থাকবে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘নির্বাচন’। এ দুটি এখন অনেকটাই অভিধানের শব্দ। বাস্তবে তার অস্তিত্ব কোথায়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফল এখন সমাজে দেখছি।’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ডাকসুর উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নাটক, বিতর্ক, সংগীত, সাহিত্য, খেলাধুলা মাধ্যমে সজীব ও প্রাণবন্ত ছিল।
যে তরুণেরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছেন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, সেই তরুণদের প্রতি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো কি সঠিক দায়িত্বটা পালন করেছে।
ভিন্নমতাদর্শের হলেও তাঁরা একসঙ্গে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—এসব আদর্শকে সামনে রেখে কাজ করেছেন। আজকের মতো এমন মেরুকরণ তখন তো দেখা যায়নি। বিদ্বেষ, ঘৃণায় একে অন্যকে তাঁরা কেউ কাউকে হাওয়া করে দিতে চাননি।
সবাই আশা করেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসায় ছাত্র-তরুণদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ আরও প্রসারিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ আরও মুক্ত ও উদার হবে। কিন্তু উল্টো তাঁরাই আক্রান্ত হলেন। সংকুচিত হয়ে গেল তাঁদের পরিসর। ডাকসুসহ সমস্ত ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। চর দখলের মতো করে ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিতে শুরু করে। তারা মনে করতে শুরু করল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলেই সমাজের অন্য অংশকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশ এখন আরেকটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখা যাচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক ক্ষেত্র। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ইরান অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলছে।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে। রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দেওয়ায় সেটা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ি গেছে। সমাজ, অর্থনীতি, বৈষম্য, কর্মসংস্থান, নৈতিকতা সবখানেই এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
সমাজ-রাজনীতির নেতৃত্বে তরুণেরা আবার কর্তারূপে বা চালিকা শক্তি হিসেবে ফিরতে না পারলে, বাংলাদেশের স্বজনতোষী ও গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর রাজনীতি-অর্থনীতির কি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসবে? রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দিয়ে দেওয়ার ফল আমরা কবে বুঝতে পারব।
সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৯ শতাংশের বেশি। একটু বাড়িয়ে যদি ৩০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়, তাহলে জনমিতিক হিস্যায় তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য এ এক বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি কিংবা নীতিনির্ধারণে তরুণেরা কোথাও কি আছেন?
একটা রূঢ় বাস্তবতা হলো, এখন যাঁদের বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে, তাঁরা ভোটার হওয়ার পর দেশে ভোট–উৎসব দেখেনি। অথচ পিউ রিসার্চের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা সংস্থার জরিপ বলছে, রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষেরা বিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে। দেশে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। সে সময়ে আজকের তরুণদের অনেকের সবে শৈশব। এর পরের দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় উৎসবের আবহ তাতে ছিল না। ভোটার হওয়ার পর প্রথম ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতাটাই তাঁদের অনেকের হয়নি।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে।
আইনজীবী, রাজনীতিক, শ্রমিকনেতা ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমদ পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনৈতিক পরিসরে পরিচিত মুখ। এ দেশের সমাজ, রাজনীতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের চালচিত্র পাওয়া যায় তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায়। ষাটের দশকে এ দেশের তরুণদের জাগরণের সঙ্গে ফ্রান্সের তরুণদের তুলনা করেছিলেন তিনি। ফরাসি বিদ্রোহের আগে থেকেই ফ্রান্সের তরুণেরা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহী।
সেই পরম্পরার প্রতিফলন আমরা আজও দেখছি। আলজেরিয়ার বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী কিশোর নাহেলকে হত্যার ঘটনায় ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। ষাটের দশকে সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসি তরুণদের বিদ্রোহে। শুধু ফ্রান্সের শিক্ষা অঙ্গনে নয়; শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলাতেও সেই অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে সমাজের সব অংশই শামিল হয়েছিল। তাতে নারী স্বাধীনতা, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ফ্রান্সের সমাজে বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছিল।
এর সমান্তরালে ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্র-তরুণদের বিদ্রোহের প্রভাব ছিল আরও গভীর। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশের জন্ম হওয়াটা সম্ভব হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় তরুণদের বিদ্রোহের কারণেই। রাজনীতিতে তরুণদের এই বিদ্রোহের জানান দেওয়া হয়ে গিয়েছিল দুই দশক আগেই—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে।
যে তরুণেরা পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই তাঁরাই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের। একইভাবে ১৯৬৮,১৯৬৯, ১৯৭০,১৯৭১ সালে তরুণ নেতৃত্ব সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলেই স্বাধীনতার দাবি পরিণতি পেয়েছিল। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় ছাত্র-তরুণেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, সামরিক শাসনের সময়ে যা হয়নি, সংসদীয় ধারার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে সেই কাজই হয়েছে। তরুণদের রাজনীতিতে উঠে আসার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী চার দশকে এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের জন্মকেন্দ্র বলে পরিচিত ডাকসুসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদকে পুরোপুরি অকেজো করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি বাম সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও তরুণদের রাজনীতিতে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এখন ষাট, সত্তর ও আশির প্রজন্মের বাইরে কেউ নেই বললেই চলে। হাতে গোনা যাঁরাও আসছেন, তাঁরা নিজেরা উঠে আসছেন, সেটা বলা যাবে না; বরং নেপিটজম অর্থাৎ বাবা-চাচা-মামা-খালার বদৌলতে এবং অর্থ ও ক্ষমতার ভারে।
এ তো গেল নেতৃত্বের জায়গা। ভোটারের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন? নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রত্যেক ভোটারের আওয়াজ সমান। পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে তাঁরা তাদের সেই আওয়াজের বাস্তবায়ন ঘটানোর সুযোগ পান। কিন্তু এটা তো কেতাবি কথা। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার যে শব্দগুলো বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, নিশ্চিতভাবেই এর শীর্ষে থাকবে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘নির্বাচন’। এ দুটি এখন অনেকটাই অভিধানের শব্দ। বাস্তবে তার অস্তিত্ব কোথায়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফল এখন সমাজে দেখছি।’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ডাকসুর উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নাটক, বিতর্ক, সংগীত, সাহিত্য, খেলাধুলা মাধ্যমে সজীব ও প্রাণবন্ত ছিল।
যে তরুণেরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছেন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, সেই তরুণদের প্রতি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো কি সঠিক দায়িত্বটা পালন করেছে।
ভিন্নমতাদর্শের হলেও তাঁরা একসঙ্গে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—এসব আদর্শকে সামনে রেখে কাজ করেছেন। আজকের মতো এমন মেরুকরণ তখন তো দেখা যায়নি। বিদ্বেষ, ঘৃণায় একে অন্যকে তাঁরা কেউ কাউকে হাওয়া করে দিতে চাননি।
সবাই আশা করেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসায় ছাত্র-তরুণদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ আরও প্রসারিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ আরও মুক্ত ও উদার হবে। কিন্তু উল্টো তাঁরাই আক্রান্ত হলেন। সংকুচিত হয়ে গেল তাঁদের পরিসর। ডাকসুসহ সমস্ত ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। চর দখলের মতো করে ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিতে শুরু করে। তারা মনে করতে শুরু করল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলেই সমাজের অন্য অংশকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশ এখন আরেকটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখা যাচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক ক্ষেত্র। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ইরান অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলছে।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে। রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দেওয়ায় সেটা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ি গেছে। সমাজ, অর্থনীতি, বৈষম্য, কর্মসংস্থান, নৈতিকতা সবখানেই এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
সমাজ-রাজনীতির নেতৃত্বে তরুণেরা আবার কর্তারূপে বা চালিকা শক্তি হিসেবে ফিরতে না পারলে, বাংলাদেশের স্বজনতোষী ও গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর রাজনীতি-অর্থনীতির কি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসবে? রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দিয়ে দেওয়ার ফল আমরা কবে বুঝতে পারব।
সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৯ শতাংশের বেশি। একটু বাড়িয়ে যদি ৩০ বছর পর্যন্ত ধরা হয়, তাহলে জনমিতিক হিস্যায় তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য এ এক বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি কিংবা নীতিনির্ধারণে তরুণেরা কোথাও কি আছেন?
একটা রূঢ় বাস্তবতা হলো, এখন যাঁদের বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে, তাঁরা ভোটার হওয়ার পর দেশে ভোট–উৎসব দেখেনি। অথচ পিউ রিসার্চের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা সংস্থার জরিপ বলছে, রাজনৈতিক সক্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষেরা বিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে। দেশে সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। সে সময়ে আজকের তরুণদের অনেকের সবে শৈশব। এর পরের দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় উৎসবের আবহ তাতে ছিল না। ভোটার হওয়ার পর প্রথম ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতাটাই তাঁদের অনেকের হয়নি।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে।
আইনজীবী, রাজনীতিক, শ্রমিকনেতা ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমদ পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনৈতিক পরিসরে পরিচিত মুখ। এ দেশের সমাজ, রাজনীতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের চালচিত্র পাওয়া যায় তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায়। ষাটের দশকে এ দেশের তরুণদের জাগরণের সঙ্গে ফ্রান্সের তরুণদের তুলনা করেছিলেন তিনি। ফরাসি বিদ্রোহের আগে থেকেই ফ্রান্সের তরুণেরা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহী।
সেই পরম্পরার প্রতিফলন আমরা আজও দেখছি। আলজেরিয়ার বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী কিশোর নাহেলকে হত্যার ঘটনায় ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। ষাটের দশকে সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসি তরুণদের বিদ্রোহে। শুধু ফ্রান্সের শিক্ষা অঙ্গনে নয়; শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলাতেও সেই অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে সমাজের সব অংশই শামিল হয়েছিল। তাতে নারী স্বাধীনতা, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ফ্রান্সের সমাজে বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছিল।
এর সমান্তরালে ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্র-তরুণদের বিদ্রোহের প্রভাব ছিল আরও গভীর। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশের জন্ম হওয়াটা সম্ভব হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় তরুণদের বিদ্রোহের কারণেই। রাজনীতিতে তরুণদের এই বিদ্রোহের জানান দেওয়া হয়ে গিয়েছিল দুই দশক আগেই—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে।
যে তরুণেরা পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই তাঁরাই মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের। একইভাবে ১৯৬৮,১৯৬৯, ১৯৭০,১৯৭১ সালে তরুণ নেতৃত্ব সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলেই স্বাধীনতার দাবি পরিণতি পেয়েছিল। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় ছাত্র-তরুণেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হলো, সামরিক শাসনের সময়ে যা হয়নি, সংসদীয় ধারার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে সেই কাজই হয়েছে। তরুণদের রাজনীতিতে উঠে আসার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী চার দশকে এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের জন্মকেন্দ্র বলে পরিচিত ডাকসুসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদকে পুরোপুরি অকেজো করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি বাম সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও তরুণদের রাজনীতিতে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এখন ষাট, সত্তর ও আশির প্রজন্মের বাইরে কেউ নেই বললেই চলে। হাতে গোনা যাঁরাও আসছেন, তাঁরা নিজেরা উঠে আসছেন, সেটা বলা যাবে না; বরং নেপিটজম অর্থাৎ বাবা-চাচা-মামা-খালার বদৌলতে এবং অর্থ ও ক্ষমতার ভারে।
এ তো গেল নেতৃত্বের জায়গা। ভোটারের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন? নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রত্যেক ভোটারের আওয়াজ সমান। পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে তাঁরা তাদের সেই আওয়াজের বাস্তবায়ন ঘটানোর সুযোগ পান। কিন্তু এটা তো কেতাবি কথা। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার যে শব্দগুলো বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, নিশ্চিতভাবেই এর শীর্ষে থাকবে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘নির্বাচন’। এ দুটি এখন অনেকটাই অভিধানের শব্দ। বাস্তবে তার অস্তিত্ব কোথায়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফল এখন সমাজে দেখছি।’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ডাকসুর উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নাটক, বিতর্ক, সংগীত, সাহিত্য, খেলাধুলা মাধ্যমে সজীব ও প্রাণবন্ত ছিল।
যে তরুণেরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছেন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, সেই তরুণদের প্রতি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো কি সঠিক দায়িত্বটা পালন করেছে।
ভিন্নমতাদর্শের হলেও তাঁরা একসঙ্গে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—এসব আদর্শকে সামনে রেখে কাজ করেছেন। আজকের মতো এমন মেরুকরণ তখন তো দেখা যায়নি। বিদ্বেষ, ঘৃণায় একে অন্যকে তাঁরা কেউ কাউকে হাওয়া করে দিতে চাননি।
সবাই আশা করেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসায় ছাত্র-তরুণদের গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ আরও প্রসারিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ আরও মুক্ত ও উদার হবে। কিন্তু উল্টো তাঁরাই আক্রান্ত হলেন। সংকুচিত হয়ে গেল তাঁদের পরিসর। ডাকসুসহ সমস্ত ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। চর দখলের মতো করে ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিতে শুরু করে। তারা মনে করতে শুরু করল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলেই সমাজের অন্য অংশকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
বাংলাদেশ এখন আরেকটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখা যাচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক ক্ষেত্র। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ইরান অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলছে।
প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন বিদেশিরা কথা বলার সুযোগ পাবে? কেন আমরা আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারব না? স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এমন একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, যাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের অভিজাত অংশ নিয়ে যে একচ্ছত্র ক্ষমতাকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটা একটা অনড় রূপ নিয়েছে। রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দেওয়ায় সেটা আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ি গেছে। সমাজ, অর্থনীতি, বৈষম্য, কর্মসংস্থান, নৈতিকতা সবখানেই এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
সমাজ-রাজনীতির নেতৃত্বে তরুণেরা আবার কর্তারূপে বা চালিকা শক্তি হিসেবে ফিরতে না পারলে, বাংলাদেশের স্বজনতোষী ও গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর রাজনীতি-অর্থনীতির কি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসবে? রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ দিয়ে দেওয়ার ফল আমরা কবে বুঝতে পারব।