আন্তর্জাতিক সুদহার বৃদ্ধির ফলে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ঋণের সুদ ও মূল পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে, মূল পরিশোধ হয়েছে ১৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন এবং সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৩০৮ মিলিয়ন ডলার।
২০২২ সালে মূল পরিশোধ করা হয়েছিল ৩৬দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার, যেখানে সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৪৬ মিলিয়ন ডলার। দেখা যাচ্ছে, তুলনামূকভাবে আগের বছরগুলোতেও সুদ পরিশোধের পরিমাণ কম ছিল।
ব্যাংকাররা জানান, এই স্বল্পমেয়াদী ঋণের জন্য ৮ শতাংশের বেশি সুদ প্রদান করতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণের জন্য সর্বোচ্চ সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) সহ ৩ শতাংশ সুদ প্রদান করতে হবে। বর্তমানে, এসওএফআর ৫ শতাংশের ওপরে দাঁড়িয়েছে, যা এক সময়ে ছিল ১ শতাংশেরও কম। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে গেছে।
উপরন্তু, বিদেশি ব্যাংকগুলো বিভিন্ন চার্জ আরোপ করেছে; এতে সুদ বাবদ সামগ্রিক ব্যয় বেড়ে গেছে বলে জানান ব্যাংকাররা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগের মাসগুলোর তুলনায় মে মাসে বাংলাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্পমেয়াদী ঋণ বেশি নিয়েছে। এক মাসে প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ঋণ পেয়েছে ২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার এবং পরিশোধ করেছে ২ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার নতুন ঋণ গৃহীত হয়েছে; একই সময়ে ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।
বিদেশি ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট সীমা বৃদ্ধি এবং দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ডলারের ঘাটতির কারণে প্রাইভেট সেক্টরের স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণ মে মাসে ২০০ মিলিয়ন ডলার বেড়েছে। যদিও আগের চার মাসে এই পরিমাণ কম ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে শেষে বেসরকারি খাতের বকেয়া (আউটস্ট্যান্ডিং) স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণ ১৪ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের মাসে ছিল ১৩ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার।
বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, নভেম্বর-ডিসেম্বরের কাছাকাছি সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলো তাদের ক্রেডিট লিমিট কমিয়েছে। এর ফলে ক্রেতাদের ঋণ এবং বিলম্বিত পেমেন্টসহ সব ধরনের স্বল্পমেয়াদী ট্রেড ক্রেডিট হ্রাস পেয়েছে।
এছাড়া, সামনের দিনে মুদ্রার মান আংশিকভাবে আরও কমতে (অবমূল্যায়ন) পারে এমন আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা এই ঋণ পরিশোধে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যদিও এই প্রবণতা এখন কমে এসেছে, কারণ ব্যবসায়ীরা এখন আগের চেয়ে বেশি ঋণ পেতে চাইছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরের শেষে ডলার প্রতি গড় বিনিময় হার বেড়ে ৯৯ টাকায় দাঁড়ায়, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৫.৮০ টাকা। বর্তমানে, এই বিনিময় হার ১০৯ টাকায় পৌঁছেছে; অর্থাৎ গত পাঁচ মাসে মুদ্রার মান কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। ভবিষ্যতে মুদ্রা অবমূল্যায়নজনিত চাপ কমার সম্ভাবনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে ব্যাংকাররা বলেন, বর্তমানে তা অনুমান করা কঠিন। তারা অবশ্য উল্লেখ করেছেন, ব্যবসায়ীরা বর্তমানে কিছু চাপের মুখোমুখি হচ্ছেন; ফলে সামনে মুদ্রার আরও অবমূল্যায়নের সম্ভাবনা রয়েছে জানা সত্ত্বেও তারা ঋণ চাচ্ছেন। তবে, ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের এমন প্রবণতাকে নিরুত্সাহিত করছে বলে জানান ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তারা বিদেশি ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট) খুলতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় মুদ্রায় এলসি খোলার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে রেখেছে। কিন্তু যখন এই লিমিট নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪-৮৫ টাকা। বর্তমানে, ডলার রেট ১০৯ টাকায় দাঁড়িয়েছে; এ কারণে টাকাকে ডলারে রূপান্তর করার ফলে ডলারে আমাদের এলসি লিমিট কমে গেছে। ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলা কমলে তা রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে।