আমাদের দেশের রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের বিভাজন রয়েছে। এটা রীতিমতো এখন আইডেন্টিটি পলিটিক্স তথা পরিচয়ের রাজনীতির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভাজনকে কেন্দ্র করেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করে আসছে। এই বিভাজনটিই মূলত বিদেশিদের নানা সুযোগ তৈরি করে দেয়। আমাদের মধ্যে যদি এই বিভাজন না থাকত, তবে বিদেশিরা এখানে নাক গলানোর সুযোগ পেত না।
আমাদের ব্যবস্থায় হয়তো কিছু ঘাটতি আছে। সেসব নিয়ে তারা এখানে কথা বলতে আসে। অথচ এ ধরনের ঘাটতি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আছে। এখন বাংলাদেশ বিষয়ে তারা বলছে, বাংলাদেশের দিকে তাদের নজর বেশি। এটা তারা করছে বেশ কিছু কারণে। বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি ভবিষ্যৎ তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে আরও উন্নয়ন হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিদেশিরাও এখানে অনেক বিনিয়োগ করেছে। তারাও একটি পার্টনারশিপ বা অংশীদারিত্ব চাইছে। যাতে তারা এখানে তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র যাচাইয়ের পাশাপাশি লভ্যাংশ বুঝে নিতে পারে।
আমরা সম্প্রতি দেখলাম আমেরিকার উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি উচ্চতর প্রতিনিধি দল আমাদের দেশ সফর করে গেল। একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে একটি প্রতিনিধি দলও সফর করেছে। তারা একটি বিষয় বলেছে, বাংলাদেশের নির্বাচনটি যেন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হয়। তারা বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল– এসব বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। সেটা অবশ্য তাদের বিষয়ও নয়। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়। হয়তো আমাদের এখানকার অনেকের আশা ছিল, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে কথা বলবেন। কিন্তু আমার মনে হয়, এ সফরে এই বিষয়ে তাদের অবস্থান ভালোভাবেই প্রকাশ পেয়েছে।
এখন বিদেশিদের বিষয়টি ততদিন থাকবে যতদিন বড় বড় রাজনৈতিক দলের মাঝে বিভাজনটি শক্তভাবে থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে– এই যে বিভিন্নজন বিভিন্ন সময়ে আসেন, কথা বলেন, পরামর্শ দিয়ে থাকেন; তাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র মজবুত হয় কিনা? আমার মনে হয়, তাদের এই আসা-যাওয়া বা কথা বলায় ওই রাজনৈতিক বিভাজনটি খুব একটা কমে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভাজন আরও বৃদ্ধি পায়। যে ধরনের নির্বাচনের কথা তারা বলছেন, আমরাও যে ধরনের নির্বাচন করতে চাই অর্থাৎ শাান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক; সেসব নির্বাচন ইউরোপে বা উন্নত দেশগুলোতে আমরা দেখতে পাই। তেমন পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি একে অপরের আস্থা থাকতে হয়। এখানে আস্থাটা নেই। এই সফরের মাধ্যমে তারা আস্থা বাড়াতে পারেন না। তারা বিভাজনটি আরও বড় করে দেন।
তারা এটা জেনে-শুনে-বুঝে করেন কিনা; আমি ঠিক জানি না। এবার তারা যে পদক্ষেপটি নিয়েছেন, তাতে বোঝা গেল, তারা নিজেরাও বুঝতে পেরেছেন, তাদের কর্মকাণ্ডে বিভাজনটি আরও বড় হচ্ছে। বিভাজনটি যত বাড়বে, সেই ধরনের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন এবং গণতন্ত্র তত দূরে চলে যাবে। যদি তারা এটা জেনে-শুনে-বুঝে করেন; বিভাজনটি বড় করতে ভূমিকা রাখেন; তাহলে বুঝতে হবে, তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। তাহলে বুঝতে পারব, এই বিভাজন বড় করার মাধ্যমে তারা তাদের বিনিয়োগ বা ব্যবসা নয়, অন্য কোনো বিষয়ে আগ্রহী। যদি না জেনে-বুঝে করেন, তাহলে বলতে হবে তাদেরকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি আরও ভালো করে জেনে নিতে হবে।
আমি মনে করি না, মার্কিন বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্মকর্তাদের এসব সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরও উন্নত হবে। এখানকার গণতন্ত্রের উন্নয়ন বা পরিবর্তন করতে হলে এখানকার জনগণের ওপরই নির্ভর করতে হবে।
আবার ঠিক এ সময়েই আমরা দেখলাম, ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচন হয়ে গেল। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। ভোটের প্রার্থী নিয়েও কথা শোনা যাচ্ছে। লক্ষণীয়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাত্র পাঁচ-ছয় মাস আগে সেখানে ভোটারদের আগ্রহ অনেক কম ছিল। এ বিষয়টাও বিবেচনা করতে হবে। সেখানে যারা প্রার্থী হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দু’জনের কথাই বেশি আলোচনায় এসেছে। একজন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী, যিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আরেকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী, তিনি পরিচিতি পেয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনোদনমূলক বিভিন্ন ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে। নির্বাচনের দিন শেষ সময়ে যে ঘটনাটি ঘটল, স্বতন্ত্র প্রার্থী– হিরো আলম নামেই যিনি অধিক পরিচিত, মারধরের শিকার হলেন। আমার মনে হয়, নির্বাচনের শেষ পর্যায়ে এসে একজন প্রার্থীর ওপর কেন হামলা করা হলো, এই বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা দরকার। যাকে হামলা করা হয়েছে, সেটি তারা চাইলে আরও এক মাস আগেই করতে পারত। কিন্তু নির্বাচনের দিন, তাও একেবারে শেষ মুহূর্তে হামলার ঘটনা ঘটিয়ে ভোটের ফলাফল বদলে দেওয়া যায় না। তাই এ হামলার ঘটনারও একটি অনুপুঙ্খ তদন্ত দরকার।
উজরা জেয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সফরের মধ্যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল দুটি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। এটা এর আগেও হয়েছে এখানে। এটাই আমাদের এখানকার গণতন্ত্র। এখন কেউ যদি হঠাৎ এখানে নরওয়ে, সুইডেন বা ফ্রান্সের মতো গণতন্ত্র দাবি করে, তাহলে তো হবে না। এখানকার গণতন্ত্র তো এমনই। এখানে গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে হলে লাখ লাখ লোককে রাস্তায় নেমে আসতে হয়। অতীতে এমনই দেখা গেছে। তাই এখানে পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচি নতুন কিছু নয়। সরকারের পালাবদলের জন্য অতীতেও এখানে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। এখনও দুই দল কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। এখানে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে জনগণের হাত ধরেই। অনেক প্রভাবশালী দেশকে হয়তো বেশ তৎপর দেখা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিবর্তন জনগণই চূড়ান্ত করে। এ ছাড়া বিদেশিদের কথা কিংবা তাদের পরামর্শে সংলাপের আয়োজন করেও অতীতে তেমন ফল আসেনি। জনগণই এখানে ক্ষমতার পালাবদলের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।