জীবনধারণের ব্যয় বেড়েই চলেছে। অন্নবস্ত্র ও বাসস্থানের খরচ বাড়ছে, সেই সঙ্গে হুহু করে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। সাধারণ জ্বর-ঠান্ডা থেকে শুরু করে জটিল অসুখ, অপারেশন আর জীবন বাঁচানোর জরুরি চিকিৎসা, ডাক্তারের ফি, প্যাথলজির পরীক্ষা, ওষুধপত্রের দাম, সবকিছুর খরচ ঊর্ধ্বমুখী। চিকিৎসা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তা আছে শুধু কাগজপত্রেই, বাস্তবে পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে।
পয়সা আছে যার, তার জন্য পথ্য অপ্রতুল নয়! ‘টাকা আছে যার, চিকিৎসা তার’—এমন একটি কথা এখন প্রচলিত। বিত্তশালীরা চাইলেই পছন্দের ডাক্তার, পছন্দের হাসপাতাল, এমনকি পছন্দের দেশে চলে যেতে পারেন চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। আজকাল নাকি একে ‘মেডিক্যাল ট্যুরিজম’ বলে! কিন্তু পকেটে যার নেই টাকা, ভ্রমণবিলাস তার জন্য ফাঁকা। চিকিৎসা তার জন্য একটা মরীচিকা, যতই এগোনো যায়, ততই তা পিছিয়ে যায়, চিকিৎসাসেবা থাকে নাগালের বাইরেই। বিশেষ করে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা এখন মৌলিক অধিকার নয়, বরং একটি সুযোগ—যা কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠীর অসমতা এতটাই তীব্র ও প্রতিকূল যে, সমষ্টিগতভাবে তা দেশের অগ্রগতির অন্তরায়।
নিম্নবিত্ত যারা, সাধারণ অসুখেও টাকা খরচের সামর্থ্য তাদের নেই। যারা মধ্যবিত্ত তাদেরও চিকিৎসার জন্য কোনো বাড়তি বরাদ্দ নেই, তাদের ভাঙতে হয় সঞ্চয়। দেশে নেই স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা। অন্যদিকে আয়ের তুলনায় অনেক গুণ বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয়। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে ঋণের অথই সাগরে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে তাদের। জটিল রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে মধ্যবিত্তরা হচ্ছে দরিদ্র, আর দরিদ্ররা হচ্ছে নিঃস্ব। এক সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে বিভিন্ন কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে দায়ী অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয়। চিকিৎসার পর রোগী সুস্থ হবে কি না, এ নিশ্চয়তা না থাকলেও, পরিবারটা যে পথে বসে যাবে, এটা প্রায় নিশ্চিত।
কেন বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়? এর উত্তরে এক কথায় একটি কারণকে সুনির্দিষ্ট করা কঠিন। একদিকে দেশে সবকিছুরই মূল্য বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্য খাতে। পরিবহন খরচ, কাঁচামাল এবং হাসপাতাল পরিচালনার খরচ বাড়ছে, আর এসবের আঁচ পড়ছে চিকিৎসার ওপর। অন্যদিকে ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত প্রাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে লাগামহীন মুনাফা লাভের মনোবৃত্তি চিকিৎসাকে পরিণত করেছে পণ্যে। চিকিৎসাক্ষেত্রে শুরু হয়েছে অনৈতিক কৌশলের মহোৎসব—দালালের ব্যবহার, ‘রোগী ভাগানো’, অযথা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা বা ওষুধ দেওয়া, অপারেশন করা, ভুল রিপোর্ট বা পরীক্ষা করা ছাড়াই রিপোর্ট প্রদান ইত্যাদি। ফলে যে চিকিত্সা স্বল্পখরচে সম্ভব ছিল, তা হচ্ছে চড়া। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এত ওষুধের ভিড়ে নিজের পণ্যটি চালাতে ওষুধ কোম্পানিগুলো যে প্রায়ই চিকিৎসক এবং ফার্মাসিস্টদের উপহার, কমিশন, বিদেশ ভ্রমণে অনুদান দিয়ে থাকে, তার খরচ শেষ হিসেবে কার পকেট থেকে আসে? আসলে সাধারণ জনগণকেই এর মাশুল গুনতে হয়।
মূল্যবৃদ্ধির পেছনে চিকিৎসা সেবার অন্তর্নিহিত কিছু কারণও আছে। রোগনির্ণয় আর নিরাময়ের নিত্যনতুন পরীক্ষা পদ্ধতি বের হচ্ছে, যার বেশির ভাগই ব্যয়বহুল। আগে রোগী দেখে যে চিকিৎসা দেওয়া হতো, এখন তা না করে হরেক রকমের পরীক্ষা আর স্ক্যান করা হচ্ছে। অসংক্রামক রোগ বাড়ছে, যেমন উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হূদেরাগ, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার ইত্যাদি। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়; কিন্তু নিরাময় হয় না, ফলে খরচের খাতা চলতে থাকে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় শুধু যে বেশিদিন রোগে ভুগতে হচ্ছে, তা-ই নয়; খরচও হচ্ছে ততোধিক। ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী চিকিৎসা খরচের সিংহভাগ জনগণকেই বহন করতে হয়। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের না আছে যথেষ্ট অর্থবল, লোকবল বা পর্যাপ্ত অবকাঠামো। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা যাও-বা আছে, তা শুধুই বিভাগ, জেলা, আর শহরকেন্দ্রিক। সরকারি হাসপাতালে মাত্র ৩৫ শতাংশ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। ৬৫ শতাংশ রোগীকে চিকিৎসাসেবা পেতে বেসরকারি হাসপাতাল বা প্রাইভেট ক্লিনিকের শরণাপন্ন হতে হয়, অতিরিক্ত খরচ হবে জেনেও।
নামমাত্র মূল্যে বা স্বল্পখরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালে। অপারেশন, সিসিইউ, আইসিইউ, ডায়ালাইসিস ইত্যাদির ক্ষেত্রে খরচ বেশ কম। কিছু ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। তুলনামূলক কম মূল্যে অধিকাংশ পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। যে কোনো অপারেশনের জন্য রোগীকে কোনো চার্জ দিতে হয় না, শুধু কিছু সরঞ্জাম এবং ওষুধপত্র বাইরে থেকে কিনতে হয়। পেয়িং বেডের রোগীদের নামমাত্র চার্জ দিতে হয়। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, সরকারি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেবার সুযোগ খুব সীমিত। রোগীর অনুপাতে পর্যাপ্ত বেড নাই, হাসপাতালের বারান্দা ও মেঝেতে রোগীদের পড়ে থাকতে দেখা যায়। ডাক্তার আর নার্সের সংখ্যা তুলনামূলক কম হওয়ায় সেবা পেতে রোগীদের হিমশিম খেতে হয়। বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর দুঃখজনক খবরও পাওয়া যায়। সদিচ্ছা থাকলেও এখানে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা দেওয়া প্রায়শই অসম্ভব। এছাড়া মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রয়েছে দালালদের দৌরাত্ম্য, ট্রলি বাণিজ্য, বিভিন্ন পর্যায়ে বকশিশ দিতে গিয়ে পদে পদে ভোগান্তি। মূল চিকিৎসার খরচ কম হলেও বাড়তি খরচ জোগাতে গিয়ে রোগীর পকেট থেকে বেরিয়ে যায় অনেক টাকা। দালাল ও কিছু অসাধু কর্মচারীর অর্থলুট ও সীমাহীন হয়রানি সরকারি হাসপাতালের স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালের ওষুধ বাইরে বিক্রিসহ দুর্নীতির কারণে অনেক ওষুধ সরবরাহ থাকার কথা থাকলেও তা পাওয়া যায় না। অপারেশনের রোগীকে অপ্রয়োজনীয় বাড়তি সরঞ্জাম কিনে ফায়দা লোটে কিছু কর্মচারী। এভাবে পদে পদে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ করতে গিয়ে, সরকারি ফ্রি চিকিৎসা আর ফ্রি থাকে না, বরং সাধারণ মানুষের জন্য দাঁড়ায় বোঝা হয়ে। তবু সরকারি চিকিৎসা গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। এখানকার দুর্নীতিগুলো বন্ধ করতে পারলে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো এবং চিকিৎসা ব্যয়ও কমানো সম্ভব।
ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূল লক্ষ্য থাকে মুনাফার। রাজধানীসহ দেশের বিভাগীয় ও জেলাশহর এবং শহরতলি সব জায়গাতেই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক। আর প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকের চিকিৎসা এবং বিশেষায়িত সেবাগুলোর খরচ সাধারণের নাগালের বাইরে। বেড চার্জ, অ্যাডমিশন ফি, পরীক্ষানিরীক্ষার খরচ সরকারি হাসপাতালের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। একই পরীক্ষা বারবার করানো, অপ্রয়োজনে বিভিন্ন দামি ওষুধ দেওয়া এবং হাসপাতালে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দিন রোগীকে ভর্তি রাখা হয় বলেও অভিযোগ আছে। বিশেষায়িত পরীক্ষাগুলো, যেমন—করোনারি এনজিওগ্রাম, সিটিস্ক্যান, এমআরআই, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাম, কার্ডিয়াক ক্যাথ, এমনকি সাধারণ পরীক্ষাগুলোর ব্যয়ও সরকারি হাসপাতালের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। স্বল্পলাভে এই পরীক্ষাগুলো আরো কম টাকায় করা সম্ভব হলেও প্রাইভেট হাসপাতাল এবং নামিদামি ক্লিনিকগুলো খরচ কমাতে চায় না। এসব ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও আছে। পরীক্ষাগুলোর সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারিত থাকলেও সর্বোচ্চ মূল্যের বেলায় একেক হাসপাতাল একেক রকম মূল্য রাখে। কার্যকর হচ্ছে না মূল্য তালিকা প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখার বাধ্যতামূলক বিধানও। হাসপাতাল আর ডাক্তারদের অভ্যন্তরীণ কমিশন বাণিজ্য তো এখন ওপেন সিক্রেট।
আইসিইউ সেবার ক্ষেত্রে রোগীদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ খরচ কম এবং সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে, তবে খুবই অপ্রতুল। কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আইসিইউ খরচ বহন করা অনেকের নাগালের বাইরে, সেখানে দৈনিক ৫০ হাজার টাকা বা তারও বেশি খরচ হয়।
বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে এটা উপলব্ধি করা জরুরি যে চিকিৎসাসেবা পণ্য হলেও এটা বাজারের আর দশটি পণ্যের মতো নয়, বরং মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতাও এখানে প্রয়োজন। কী ধরনের সেবায় কতটুকু লাভ রাখা যাবে, তার একটি নীতিমালা কার্যকর করতে হবে। বিশেষ করে জীবন রক্ষাকারী অপরিহার্য সেবাগুলোর যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। হাসপাতাল বা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার শর্ত থাকতে হবে। এসব হাসপাতালের কর্মকাণ্ড আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানদণ্ড অনুযায়ী চলছে, নাকি ব্যাবসায়িক লাভের প্রণোদনায় চলছে, তা নিয়মিত পর্যালোচনা করতে হবে।
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতে বেশকিছু সাফল্য রয়েছে। আজ দেশে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। হার্ট, লিভার, কিডনিসহ অন্যান্য সার্জারিতে অনেকদূর এগিয়ে গেছে দেশ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের মতো কঠিন অপারেশনও সম্ভব হচ্ছে এ দেশে। তবে এ ধরনের চিকিৎসায় যে বিপুল অর্থব্যয় হয়, তা দেশের খুব কম মানুষের পক্ষে জোগান দেওয়া সম্ভব। এ ব্যয়ভার কমিয়ে সাধারণ মানুষ যাতে চিকিৎসা পেতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
তবে শেষ বিচারে সরকারি হাসপাতালই দরিদ্র মানুষের আশা-ভরসার মূল আশ্রয়। তাই এখানে বরাদ্দ বাড়ানোসহ দরকার লোকবল আর অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন। চিকিৎসাসেবার আধুনিক যেসব উপকরণ অপরিহার্য; কিন্তু ব্যয়বহুল, যেমন জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, জরুরি ও আইসিইউ সেবা, কার্ডিয়াক ক্যাথ, সার্জারি, ট্রান্সপ্ল্যান্ট, জরুরি প্রসূতিসেবা ইত্যাদিকে আরো ভর্তুকি দিয়ে দরিদ্রের জন্য সুলভ করা প্রয়োজন।
আসলে সুলভে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা এবং সহনীয় চিকিৎসা ব্যয়ের বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং সেবা দানকারীদের মন-মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। নিত্যনতুন টেকনোলজি আর অবকাঠামোর আশায় বসে না থেকে যে উপকরণ আছ, তার সর্বোচ্চ আর সুষ্ঠু ব্যবহার চিকিৎসার ব্যয় কমিয়ে আনতে পারে। পরীক্ষানিরীক্ষার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল না হয়ে ক্লিনিক্যাল জাজমেন্টকে প্রাধান্য দিলে খরচ প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমানো যেতে পারে। হাসপাতালকে রোগীবান্ধব করে তুললে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব।