এ কথা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কতিপয় শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত আছেন, আর এই বাণিজ্যের লক্ষ্মী তাদের ক্লাসের শিক্ষার্থীরা। এরা হচ্ছে তাদের বাঁধা কাস্টমার। লক্ষ করা গেছে, তারা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনযোগী না হয়ে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখেন। ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা শিক্ষকদের পরিচালিত কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে বাধ্য হন। এমনও অভিযোগ পাওয়া যায়, সাবজেক্টের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষার্থীকে ফেল পর্যন্ত করিয়ে দেওয়া হয়; আর প্রাইভেট পড়লে পরীক্ষায় ভালো করার নিশ্চয়তা থাকে। শ্রেণিকক্ষের লেখাপড়া পর্যাপ্ত না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করতে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। এতে দরিদ্র শ্রেণির অভিভাবকগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যাদের নুন আনতে পান্থা ফুরায়, তাদের অবস্থা তো আরো শোচনীয়। আয়ের এক বিরাট অংশ সন্তানদের প্রাইভেট পড়াতে চলে যায়। এখানে শিক্ষার্থী বলতে প্রাইমারি স্কুল থেকে ভার্সিটির ছাত্রছাত্রী পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
আগে যখন প্রাথমিক সমপানী ও জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা ছিল, তখন উন্নত ফলাফলের নামে স্কুলেই কর্তৃপক্ষের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে কোচিং বাণিজ্য। এখনো এই বাণিজ্য আছে এবং এর কারণে পঞ্চম শ্রেণিসহ কয়েকটি ক্লাসে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গড়ে উঠেছে কোচিং ব্যবস্থা। স্কুলের সময় শেষে এখানে কোচিং করা হয়। এই কোচিংয়ে ভর্তি না হলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে টর্চার করা হয়। সবাইকে যদি কোচিং করতে হবে, তাহলে মূল ক্লাস রেখে লাভ কী? ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট খারাপ করানো ভয়াবহ অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি হতে হবে। অনেক সময় এর জন্য সিলেবাস কঠিন করা হয়, অতিরিক্ত বই চাপিয়ে দেওয়া হয়। অতিরিক্ত ব্যাকরণ ও গ্রামার বইয়ের কঠিন ও শেষ অংশ থেকে এমন সব পাঠ যোগ করা হয়, যাতে এক জন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীর মাথা ঘুরে যায়। এতে মূল বইয়ের পড়াশোনো গৌণ হয়ে পড়ে। এমন মতলবি শিক্ষাবাণিজ্য অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে কোচিং বাণিজ্য ও অভিভাবকদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে সরকার ২০১২ সালে কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নিমিত্তে নির্দেশনা জারি করে, যা সরকারের উপলব্ধি এবং মহামান্য হাইকোর্টের আদেশে ২০১৯ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। কারণ কোচিং বাণিজ্য বন্ধের জন্য ভুক্তভোগী অভিভাবকদের পক্ষে হাইকোর্টে রিটও করা হয়। উক্ত গেজেটে কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীকে কোচিং করতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তবে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে তিনি অন্য স্কুলের অনধিক ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। নিয়মিত ক্লাসের পর অনধিক ৪০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে মাসে ১২টি ক্লাসের জন্য সর্বোচ্চ ৩০০ টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানপ্রধান স্বীয় স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারেন। তবে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধান বেতনের টাকা কমাতে বা মওকুফ করতে পারেন। প্রাইভেট পড়ার বেতন বাবদ টাকা থেকে ১০ শতাংশ পানি, বিদ্যুৎ ও সহায়ক কর্মচারীদের খরচ বাবদ বাদ দিয়ে বাকি টাকা শিক্ষকদের প্রাপ্য হবে মর্মের নীতিমালায় বলা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ কোচিং বাণিজ্য রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে গেজেটে বলা হয়েছে। এই ব্যবস্থাও কোচিং ব্যবসার অনুকূল। আমরা স্কুলে ও এর আশপাশে কোনো ধরনের কোচিং রাখার পক্ষপাতী নই। কেননা, কোচিং থাকলেই আসল লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা, শিক্ষকেরা অতি লোভে শিক্ষার্থীদের মূল ক্লাসে ভালোভাবে পড়াবেন না। আর এই সমস্যাটাই এখন প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। শিক্ষা নামক জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা হলে তারা কেন কোচিং-নির্ভর হবেন?
আমাদের কথা হলো, মূল বই ও মূল ক্লাসকে প্রাধান্য দিতে হবে। এর পরও যারা দুর্বল থাকবে, অভিভাবক তাদের জন্য গৃহশিক্ষক রাখাসহ নানা পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু কোচিংকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যাবে না। নোট-গাইড বইসহ সব রকম সহায়ক বই নিষিদ্ধ করতে হবে। কেননা, এগুলো শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের জন্য সহায়ক নয়, বরং প্রতিবন্ধক।
এমপিওভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নীতিমালা ভঙ্গ করলে এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন-ভাতা স্থগিত, বাতিল, বেতন এক ধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তি অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আরোপ করা যেতে পারে মর্মে নীতিমালায় বলা আছে। এমপিওবিহীন শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। নীতিমালার বাস্তবায়ন তদারকির জন্য মেট্রোপলিটান ও বিভাগীয় শহরে অতিরিক্ত বিভগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছ। জেলা ও উপজেলা এলাকায়ও তদারকির জন্য অনুরূপ কমিটি গঠন করার কথা বলা আছে। পরিচালনা পর্ষদ কোচিং বাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াসহ সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের অনুমতি, স্বীকৃতি, অধিভুক্তি বাতিল করতে পারবে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নীতিমালা ভঙ্গের জন্য অসদাচরণের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা গেজেটে বলা আছে। যেহেতু এই ব্যবস্থায় কোচিং বন্ধ হয়নি, অভিভাবকদের আসল সমস্যার সমাধান হয়নি, তাদের উদ্বেগ দূর হয়নি, তাই এই নীতিমালারও সংশোধন জরুরি।
এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতি গঠনের পীঠস্থান। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘকালব্যাপী কোনো অনিয়ম বিরাজ করলে এর কুফল জাতির জীবনে সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলবে। তাই শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার দরকার নেই। দরকার নেই তাদের ভাষা ভাষা জ্ঞানেরও। মূল বইয়ের মাধ্যমে ব্যাসিক জ্ঞানার্জনকে গুরুত্ব দিয়ে আনন্দময় পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে।