প্রায় ১ মাস ধরে দেশের সর্ববৃহৎ জলাভূমি হাকালুকি হাওড়পাড়ের বড়লেখা উপজেলার ১০ ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভা এলাকার প্রায় দেড় লাখ বাসিন্দা ভয়াবহ বন্যায় পানিবন্দি জীবন যাপন করছেন। দুর্যোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে এবারের ঈদ তাদের কাছে ম্লান হয়ে গেছে।
হাকালুকি হাওড়পাড়ের মুর্শিবাদকুরা গ্রামের বাসিন্দা নেহারুন বেগম। বন্যায় তার ঘর-দুয়ার সব ভেঙে গেছে। এই অবস্থায় পরিবার নিয়ে হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন। প্রায় এক মাস হতে চলেছে। বন্যার পানি না নামায় নেহারুনের আর বাড়ি ফেরা হয়নি। তাই তাকে এবার আশ্রয় কেন্দ্রেই নিরানন্দেই ঈদ করতে হয়েছে।
এভাবেই রোববার ঈদুল আজহার দিনটি কেটেছে ৫০ আশ্রয় কেন্দ্রের ৬ সহস্রাধিক বানভাসির।
হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে কথা হয় নেহারুন বেগমের সঙ্গে। ঈদ কীভাবে কাটছে জানতে চাইলে অসহায় চাওনিতে তিনি জানান, ‘আমরার ঈদর সব আনন্দ বন্যায় কাড়িয়া নিছেগি। বন্যায় আমরারে একেবারে শেষ করি দিছে। ঘর-দুয়ার সবতা ভাঙিয়া লইয়া গেছে। পরিবার নিয়া আশ্রয় কেন্দ্রে আইজ প্রায় ১ মাস ধরি আছি। খুব কষ্টে দিন যার। আশ্রয় কেন্দ্রে আইছলাম শান্তির লাগি। ইকানো আইয়া মনে অর আমরা অপরাধ করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একদিন ইউএনও সাহেব হুখনা (শুকনো) খাবার ও একদিন মন্ত্রী চাউল-ডাইল অতা তোড়া দিছইন। আর দুই তিন-দিন খিচুড়ি আর পোলাও পাইছি। ইতায় তো পেট ভরে না। ছেলের রুজি নাই। মানইষের কাছে হাত পাতিয়ার। বাইরা থাকি কেউ ত্রাণ লইয়া আইলে মেম্বার- চেয়ারম্যানে আশ্রয় কেন্দ্রে দিতে দেইন না। আমরা কি কষ্টে আছি এটা আল্লাহ দেখরা। একবার খাইতে পারলে আরেকবার খাইতে পারিয়ার না। এই কষ্টটা কইয়া বুঝানি যাইতো নায়। ঈদের একটা সময় কেউ আমরার খোঁজ নিছে না। নাতি-নাতিন লইয়া কষ্ট করি চলা লাগব। কষ্টের মাঝে বাড়ির বাইরা কিওর (কিসের) ঈদ। ঘরে ঠিকমতো চাউল-খরচপাতিউ কিছুই নাই।’
নেহারুন বেগমের মতো বড়লেখা উপজেলার বন্যা কবলিত অধিকাংশ এলাকার মানুষদের যেন ঈদের আনন্দ স্পর্শ করতে পারেনি। বিশেষ করে বড়লেখা উপজেলার ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষের মনে ঈদ উৎসবের কোনো আমেজ নেই। কারণ তাদের সব আনন্দ ভেসে গেছে বানের জলে।
একই আশ্রয় কেন্দ্রে পরিবার নিয়ে উঠেছেন তাজুল ইসলাম। তিনি হাঁস-মুরগি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। বন্যায় হাট-বাজার তলিয়ে যাওয়ায় তিনি এখন বেকার।
ঈদের দিন কীভাবে কাটাবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২৪ দিন ধরে আছি আশ্রয় কেন্দ্রে। কাম-কাজ নাই। আশ্রয় কেন্দ্রে আইয়া সরকারি হুখনা (শুকনো) খাবার ও একদিন পরিবেশ মন্ত্রী চাউল-ডাউল অতা দুইদিন পাইছি। আর কেউ আমরার খোঁজ নেয়নি। সরকারিভাবে আমরার কেউ খোঁজ নিছে প্রমাণ দিতে পারলে আমরারে যে শাস্তি দিবা আমরা মানিয়া নিমু। আমরা অসহায় হওয়ায়ই আশ্রয়কেন্দ্রে আইছি। কোনো খরচ নাই ঘরে। হাতে টাকাও নাই। পুরান কাপড়, নিজের ঘর ছাড়া স্কুলে আছি। ঈদ কিলা কাটব ইতা আপনারাই বুঝইন।
কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র ঘুরে কথা হয় আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষদের সঙ্গে। তারা জানিয়েছেন, এবারের ঈদুল আজহায় তাদের কোনো আয়োজন নেই। অন্য বছরগুলোতে সাধ্যমতো তারা কেনাকাটা করেন। ঈদে সবাই মিলে আনন্দ করতেন। কিন্তু এবার তাদের মনে কোনো আনন্দ নেই।
ইউএনও খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী রোববার বিকালে বলেন, ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রের ৪০টিতে এখনও দুর্গত মানুষ বসবাস করছেন। ১০টি আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজনের বাড়ি থেকে পানি নেমে যাওয়ায় তারা বাড়ি চলে গেছেন। জেলা প্রশাসন থেকে একটা গরু দেয়া হয়েছে। ঈদের দিন রান্না করে আশ্রয়কেন্দ্রের বন্যার্তদের খাওয়ানো হয়েছে। বন্যার পানিতে যারা আটকে থেকে কুরবানি করতে পারছে না, তাদেরও দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৪০০ প্যাকেট খাদ্যদ্রব্য ঈদ উপহার হিসেবে আশ্রয়কেন্দ্রে বিতরণ করা হয়েছে।