করোনা মহামারিকালে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও শিশু জন্মের হার নিকট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। লকডাউন, হোম অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধসহ এমন কিছু বিষয় বিবেচনায় সন্তান জন্মদানের এটাই সঠিক সময় বলে মনে করে অনেক পরিবার। ফলে প্রসূতি ও নবজাতক মৃত্যুহার এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় করোনা মহামারি। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে করোনাকাল বিবেচনায় নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরি জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা ।
এমন অবস্থায় আজ ১১ জুলাই পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। করোনা মহামারির চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে, ‘৮০০ কোটির পৃথিবী : সকলের সুযোগ, পছন্দ ও অধিকার নিশ্চিত করে প্রাণবন্ত ভবিষ্যৎ গড়ি’। করোনাকালে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ বৈশ্বিক মহামারি শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা একাধিক প্রতিবেদনে এই সময়ে সারা বিশ্বে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ফলে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়াসহ বেশ কিছু আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। করোনা পরিস্থিতিতে বাল্যবিয়ের ঘটনাও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হয়। গত আড়াই বছরে যার সত্যতা মিলেছে। এতে বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও সামাজিক সংকট বেড়ে গেছে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে জন্ম নেওয়া ২৫০টির মধ্যে বাংলাদেশে ১০টি শিশু জন্ম নিচ্ছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ১৮৬০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র দুই কোটি। ১৯৪১ সালে তা বেড়ে হয়েছিল চার কোটি ২০ লাখ। অর্থাৎ ৮১ বছরে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ে মাত্র দুই কোটি ২০ লাখ। আবার ১৯৬১ সালে জনসংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি ৫২ লাখ, যা ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি ১০ লাখ। অর্থাৎ ৩০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১২ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ২৭ লাখ। ২০১৬ সালের জুলাইতে এই জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটি আট লাখ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ এক হাজার। সে হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। এই হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২২ কোটি ২৫ লাখে, যা জন্মনিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধ ইত্যাদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মেরী স্টোপস-বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি বিভাগের প্রধান মনজুন নাহার। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনাকালে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত এবং অনিরাপদ সন্তান প্রসবের বিভিন্ন ঘটনা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। অধিকাংশ দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে এটি একটি সাধারণ প্রবণতাও। তিনি আরো বলেন, করোনা মহামারির প্রথম দুই-তিন মাস পরিস্থিতি বুঝতে সময় নিলেও, পরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় মেরী স্টোপস নিরাপদ মাতৃত্ব, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারসহ এসংক্রান্ত যাবতীয় সেবা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছে।
ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একযোগে বলছে, করোনার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি জনবহুল দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় কভিডের কারণে আশঙ্কাজকন হারে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় এবং স্কুল বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ে বেড়েছে। যার ফলে ইউএনএফপিএর প্রতিবেদন বলছে, অতিরিক্ত ৩ দশমিক ৫ লাখ শিশু গর্ভবতী হয়েছে। ১ দশমিক ৯ লাখ শিশু পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। লকডাউন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় কর্মসংস্থান, অর্থনীতি, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
একাধিক বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, বর্তমানে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়স নারীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। এই বয়সে তারা প্রজনন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে তেমন সচেতন থাকে না। এ অবস্থার কারণে বাংলাদেশে অনেক নবজাতকের মৃত্যু হয়। আবার সন্তান প্রসবের পর মা ও শিশু রোগাক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালের তিনজন মেয়ের মধ্যে একজনই রুগ্ণ। আর মেয়েদের ১১ শতাংশই অনেক বেশি রোগা-পাতলা। তাদের অধিকাংশেরই জিংক, আয়োডিন ও আয়রনের মতো পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে। পুষ্টিকর খাবার না পাওয়া এবং অল্প বয়সে গর্ভধারণের কারণে বাংলাদেশের কিশোরী মেয়েরা অপুষ্টিতে ভুগছে।
এ অবস্থায় জনসচেতনতা সৃষ্টিই বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী আ খ ম মহিউল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে সকলের সম্পৃক্ততায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অনলাইন স্বাস্থ্যসেবার আওতা বাড়াতে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নতুন করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে সেবা গ্রহণ বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা তথ্য সরবরাহের পরিবর্তে অ্যাপভিত্তিক সেবা বাড়াতে হবে। সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী উভয় পক্ষকেই মোবাইলের ব্যবহার বৃদ্ধি করে ডিজিটাল সেবায় দক্ষ করতে হবে।
করোনা পরিস্থিতি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্ত করেছে উল্লেখ করে উন্নয়ন সংস্থা ‘টিম অ্যাসোসিয়েট’-এর টিম লিডার পুলক রাহা বলেন, পরিবার পরিকল্পনায় এখনই যথাযথ উদ্যোগ না নিলে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে বাধাগ্রস্ত হবে সকল উন্নয়ন। তাই সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে অ্যাপভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষ করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সুখী পরিবার নামক কল সেন্টার ‘১৬৭৬৭’ নম্বরে কল করে সরাসরি ডাক্তারের কাছ থেকে সেবা গ্রহণে গ্রামীণ নারীদের আগ্রহী করে তুলতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।