পাকিস্তানের রাজনীতিতে এখন আলোচিত দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। গত বছর পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে তিনি একেরপর এক বাধার সম্মুখীন হয়ে আসছেন। সবশেষ তোশাখানা মামলায় দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে আছেন এই ক্রিকেট তারকা। সম্প্রতি মার্কিনভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্য ইন্টারসেপ্ট ইমরানের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বিষয়ে এক গোপন নথি ফাঁস করেছে।
পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম বলা হয়, ক্ষমতায় থাকাকালীন ইমরান খান রাশিয়া সফর করে আমেরিকার তোপের মুখে পড়ে। প্রকাশ হওয়া নথি অনুযায়ী, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইসলামাবাদে এ বিষয় অবগত করলে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কারণ স্বরূপ সেটিকে মার্কিন ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
ফাঁস হওয়া নথিতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর সহকারী সেক্রেটারি অব স্টেট ডোনাল্ড লু এবং পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আসাদ মাজিদ খানসহ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যকার একটি বৈঠকের বিবরণ রয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বালোচ বলেন, ফাঁস হওয়া নথির বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। তথ্যমন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব এবং পরিকল্পনামন্ত্রী আহসান ইকবালও কোনো মন্তব্য করেননি।
অপরদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশিত নথির সত্যতা সম্পর্কে মন্তব্য করেনি। তারা বলেছে, নথির বিষয়বস্তুতে এরকম কোনো কিছু ছিল না যা দেখে মনে হতে পারে পাকিস্তানের ক্ষমতায় কে আসবে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে।
ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে ইমরান খানের পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র আপত্তি জানিয়েছে। ডোনাল্ড লু ইউক্রেন সঙ্কটে পাকিস্তানের অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, এখানকার এবং ইউরোপের লোকেরা যুদ্ধে ইউক্রেনের বিষয়ে পাকিস্তানের এমন আক্রমণাত্মক নিরপেক্ষ অবস্থানের বিষয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। আমাদের কাছে পাকিস্তানের অবস্থানকে নিরপেক্ষ বলে মনে হয়নি। এনএসসির সঙ্গে তার আলোচনায় বেশ স্পষ্ট বলে মনে হয়েছে এটি ইমরান খানের নীতি।
জবাবে আসাদ মাজিদ খান বলেছিলেন, এটি পরিস্থিতির সঠিক তথ্য নয় কারণ ইউক্রেনের বিষয়ে পাকিস্তানের অবস্থান তীব্র আন্তঃসংস্থা আলোচনার ফলেই এসেছিল। আমি লু কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর প্রতিক্রিয়ার কারণ কি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভোটদান থেকে পাকিস্তানের বিরত থাকা। তিনি স্পষ্টভাবে না বলে দিয়েছিলেন এবং বলেছেন এটি কেবল প্রধানমন্ত্রীর (ইমরান খান) মস্কো সফরের কারণে হয়েছিল।
ফাঁস হওয়া নথি অনুসারে লু বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি যদি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট সফল হয় তবে ওয়াশিংটনে সবাইকে ক্ষমা করা হবে কারণ রাশিয়া সফরকে শুধু প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্যথায়, আমার ধারণা এটি এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের মন্তব্য এটাই প্রমাণ করে, ইমরান খান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যে মার্কিন অভিযোগ এনেছিলেন তা অমূলক নয়। লুর কথাগুলো এক ধরনেই স্পষ্টতই হুমকি ছিল।
পাকিস্তানের একজন সিনিয়র কূটনীতিকের মতে, ‘অবশ্যই কোন ষড়যন্ত্র ছিল না, তবে একজন মার্কিন কর্মকর্তার কাছ থেকে এ জাতীয় শব্দের ব্যবহার অগ্রহণযোগ্য। কেননা লু বলেছিলেন যদি অনাস্থা ভোট সফল হয় তবে সব ক্ষমা করা হবে।’
আসাদ মাজিদ খান মার্কিন কূটনীতিককে আরও জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে ইউক্রেনের বিষয়ে পাকিস্তানের অবস্থান যদি ওয়াশিংটনের কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে কেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের রাশিয়া সফরের আগে ইসলামাবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়নি।
জবাবে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘ওয়াশিংটনের চিন্তাভাবনা ছিল পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে, এই ধরনের ব্যস্ততার জন্য এটি সঠিক সময় নয় এবং এটি পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থির হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।’
নথি ফাঁস হওয়ার পর সেটির উল্লেখ করে আসাদ মাজিদ খান বলেন, লু হোয়াইট হাউজের স্পষ্ট অনুমোদন ব্যতীত এমন একটি জোরালো অনুভূতি প্রকাশ করতে পারতেন না, যা তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন।
যদিও দ্য ইন্টারসেপ্ট তার প্রতিবেদনে দাবি করেছে, তাদের নথিটি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একটি বেনামী উৎসের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছিল। তবে তিনি বলেছিলেন, ইমরান খান বা তার দলের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকের ধারণা নথি ফাঁসের উৎস পিটিআই নিজেই হতে পারে।
এখানে নথি ফাঁস হওয়ার সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তোশাখানা মামলার রায়ের পরেই তা প্রকাশ্যে এসেছে।
প্রোটোকল অনুসারে, শুধু গুটিকয়েক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের গোপন নথিতে অ্যাক্সেস ছিল। এর মধ্যে রয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান। ইসলামাবাদে একটি জনসভায় ইমরান খানের মাধ্যমে নথিটির অস্তিত্ব প্রথম প্রকাশ করার পরে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভাতে গোপন নথির বিষয়বস্তু নিয়ে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছিল।
এদিকে নথি ফাঁস হওয়ার পর পরোক্ষ স্বীকারোক্তিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বলেছেন, ‘যদিও এই গল্পে নতুন কিছু নেই, তবে তথ্যের সত্যতা প্রতিষ্ঠা কিংবা নথির উৎস জানার জন্য তদন্ত করা দরকার। সম্ভবত এটি একটি অত্যন্ত অশুভ, বিশ্বাসঘাতক এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিক্রিয়া
বুধবার এক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার নিশ্চিত করেছেন যে ওয়াশিংটন পাকিস্তান সরকারের কাছে ব্যক্তিগতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। তারপরে প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের দিনেই মস্কোতে সফর করে একই কাজ করেছিলেন। তবে তিনি ফাঁস হওয়া নথির সত্যতা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
মিলার বলেন, এই বিষয়গুলো কখনোই এটা প্রমাণ করেনা যে পাকিস্তানের ক্ষমতায় কে বসবে তা যুক্তরাষ্ট্র নির্ধারণ করতে পারে। আমি মনে করি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যে নীতি গ্রহণ করছে তা নিয়ে মার্কিন সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মাত্র। পাকিস্তানের নেতৃত্বের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।