বান্দরবানে পাহাড়ধস আতঙ্ক বিরাজ করছে। জেলার সাত উপজেলা ও দুইটি পৌর এলাকায় পাহাড়ের ঢালুতে বসবাস করছে প্রায় ৪০ হাজার পরিবার, যার মধ্যে ২০ হাজার পরিবার অতিঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
পাহাড়ি এই জেলায় সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলো হলো বান্দরবান সদরের ইসলামপুর, লাঙ্গিপাড়া, হাফেজঘোনা, কালাঘাটা, বনরুপা, ক্যচিংঘাটা, কাসেমপাড়া, লামা উপজেলার আজিজনগর, হরিণমারা, ফাইতং, গজালিয়া, রুপসীপাড়া, সরই, ফাঁসিয়াখালি, পৌর এলাকার হাসপাতাল পাড়া, নুনারবিল, টি অ্যান্ড টি পাড়া, আলীকদম উপজেলার পোয়ামুরী, ক্রুপপাতা, বাবুপাড়া ও আমতলী।পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের অধিকাংশই হতদরিদ্র শ্রমিক।
সরকারি হিসেবে বান্দরবানে পাহাড়ধসে ২০০৯ সাল থেকে ১৫ বছরে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৯ সালের ৩০ আগস্ট পাহাড়ধসে আজিজনগর ও গজালিয়ায় ১১ জন, ২০১০ সালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় পাঁচ জন, ২০১১ সালে রোয়াংছড়ি উপজেলায় দু’জন, ২০১২ সালে লামা উপজেলার ফাইতং, রুপসীপাড়া ও লামা সদর ইউনিয়নে ১৫ জন, ২০১২ সালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ১০ জন, ২০১৫ সালে লামা ও বান্দরবান সদরে আট জন, ২০১৭ সালের ১৩ জুন সদরের কালাঘাটায় সাত জন ও রুমা উপজেলায় পাঁচ জন, ২০১৮ সালে লামা উপজেলায় তিন জন ও সদরের কালাঘাটায় একজন, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই লামায়, ২০২০ সালে আলীকদমে একজন করে, ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রোয়াংছড়ির সাইঙ্গ্যা ঝিড়িতে একই পরিবারের তিন জন, ২০২৩ সালের ১২ আগস্ট পর্যন্ত বান্দরবান সদর, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়িতে ১০ জন মারা যান।
পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ধসের এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে মানুষের কর্মকাণ্ড। পাহাড়ের ঢালে অপরিকল্পিতভাবে বসত নির্মাণ, বসবাসের প্রয়োজনে জঙ্গল পরিষ্কার, পাহাড় কেটে সরকারি রাস্তা তৈরি, মাটি কেটে ইটভাটার ব্যবহার, প্লট তৈরি করে বসতঘর নির্মাণ, খাদ্যের প্রয়োজনে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জুমচাষ, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল কর্তৃক নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে পাহাড় আবরণহীন হয়ে পড়ছে। ফলে পাহাড়ে ভূমি ক্ষয়ও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ অঞ্চলে পাহাড়ধসের ঘটনা বছর বছর বাড়ছে।
স্থানীয়রা জানান, গঠনগত কারণে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে পাহাড়গুলোতে ছোট ছোট ফাটলের সৃষ্টি হয় এবং ফাটল সংলগ্ন স্থানে ক্ষয় শুরু হয়। পাহাড়ে ঠিকমতো পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় বৃষ্টির পানির সঙ্গে ক্ষয়ীভূত পদার্থগুলো নিম্নঢালে সবেগে চাপ প্রয়োগ করে আবার অন্যদিকে বৃষ্টির পানি এসব ফাটলে ঢুকে বড় আকারে ধস নামায়। পাহাড়ের যে অংশে জনবসতি বেশি এবং মানুষের বিচরণ বেশি সে এলাকাগুলোতে ধস বেশি হয়।
মৃত্তিকা বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়ের বন নির্বিচারে ধ্বংস করাতে মাটি আবরণহীন হয়ে পড়ে। আবরণহীন মাটিতে রোদ বৃষ্টি ও মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে মাটি শিথিল হয়ে ধস হয়। এ ছাড়াও পাহাড়ি ঢলের পানি নির্গমনপথে ঘরবাড়ি ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করায় নির্গমন পথ বন্ধ হয়ে পাহাড়ধস হয়।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পাহাড়ধসের ক্ষেত্রে যেহেতু প্রকৃতির চেয়ে মানুষের ভূমিকা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ তাই বাস্তবে এটি পরিবেশগত বিপর্যয়। এই বিপর্যয় মোকাবিলায় একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন এবং পাহাড় কাটা প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি ও বন্যায় এ পর্যন্ত বান্দরবানে পাহাড়ধসে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক। তাই জেলার ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক জানান, এবারের বন্যায় জেলায় ১৫ হাজার ৮০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন হাজার ৫৭৮ পরিবার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। আট হাজার ২৫৩ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাহাড়ধসে সড়কগুলোর ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে কাজ চলছে।
২ আগস্ট থেকে একটানা বৃষ্টির কারণে রুমা ও থানচি উপজেলার সড়কে ব্যাপক পাহাড়ধস হয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তার চিহ্ন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাত দিন ধরে জেলা শহরের সঙ্গে রুমা-থানচি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। রুমা সড়কের দলিয়ান পাড়ার প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকার অনেক স্থানে পাহাড়ধসে রাস্তা ভেঙে গেছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন চৌধুরী জানান, এবারের পাহাড়ধস ও বন্যায় বান্দরবানের সড়কগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে রুমা থানচি সড়ক মেরামত করে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরায় চালু করতে বেশ সময় লাগবে। তবে কাজ শুরু করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।