আবহমান বাংলায় বর্ষাকালের চিরায়ত দৃশ্যপটে প্রকটিত ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’র মাঝে প্রকৃতিতে লুটিয়ে পড়ল শরৎ। দেশ জুড়ে এখনো আষাঢ়-শ্রাবণে ‘ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে’র বর্ষাপ্লাবিত পরিবেশ ঘিরে আছে। নদনদী, খাল-বিল, মাঠঘাট টইটম্বুর। অবিরাম ভারী বর্ষণ আর উজানি ঢলে বন্যার পূর্বাভাসের মধ্যে বিদায় নিল বর্ষা ঋতু। প্রকৃতির মালিন্য মুছে দিতে মেঘের সিংহবাহনে শরৎ এলো মধুর মুরতি নিয়ে।
আজ পহেলা ভাদ্র। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুর পালাবদলে ভাদ্র-আশ্বিন টানা দুই মাস শরতের রাজত্বকাল। এসেছে শরৎ। নির্মল নীলাকাশ, গুচ্ছ গুচ্ছ শুভ্র অমল ধবল মেঘের ভেলা; দূরে দুধেল সাদা কাশের বনে পাগলা হাওয়ার মাতামাতির দিনলিপির কাল। মিষ্টি ঘ্রাণের শিউলি চুপি চুপি বলে যায়—‘আজি এ শরৎ বেলা’।
‘আজ ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/ নীলাকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা’—পঙক্তিতে কবিগুরু শরেক ‘স্বল্পায়ু’ বলেছেন। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রতিটি ঋতুই ভিন্ন ভিন্ন রূপবৈচিত্র্য নিয়ে সামনে আসে। নতুন করে সাজে প্রকৃতি। গ্রামে যেমন, শহরেও তাই। এখন গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে নবীন ধানের সাথে কাশফুলের দোলা আর শহরের নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুপম রূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত শরতের মমতামাখা নাম দিয়েছেন ‘শারদ লক্ষ্মী’। ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা/ নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা/ এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে/ এসো নির্মল নীলপথে।’
প্রকৃতির সবুজ ছড়িয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে। এই স্নিগ্ধরূপ তারুণ্যকে উচ্ছ্বসিত আনন্দে ভাসার উদ্বেগ সৃষ্টি করে। প্রকৃতি তার ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতে চায় সকল মনকে। শরৎ সেই ভালোবাসার মনে দোলা দিয়ে যায়। ঋতুরানি শরতে শুধু কাশফুল নয়, এ ঋতুতে শিউলি, হাসনাহেনা, জুঁই, চামেলি, কেয়া, কদমসহ নানা ফুল ফোটে। খালে বিলে শাপলা ও শালুকের সমারোহ। মহাকবি কালিদাস শরতের বন্দনা করেছেন: ‘প্রিয়তম আমার! ঐ চেয়ে দেখ, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’ শরতের প্রভাত সূর্য শিশিরসিক্ত বাতাসে ভর করে নীল আকাশকে রাঙিয়ে লাজুক করে তোলে। গগনে গগনে শুধু অপরূপ রূপের লীলাখেলা। ভুবন জুড়ে এক নতুন দৃশ্যপট রচিত হয় :‘আজি কি তোমার মধুর মুরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে!/ হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ ঝলিছে অমল শোভাতে।’
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ শরতের চরিত্রের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমাকে। প্রেম-দ্রোহের কবি নজরুলকেও আলোড়িত করেছিল শরতের প্রকৃতি। বিশেষ করে শরতের শিউলি তাকে মুগ্ধ করেছিল। ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে।/ এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে। শরতের মিষ্টি সকালও উৎকীর্ণ হয়েছে :‘শিউলিতলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।/ শেফালি ফুলকে ঝরে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা।