ভোজ্য তেল হলো একধরনের লিপিড, যা উদ্ভিজ্জ প্রাণী বা সিন্থেটিক যৌগ থেকে তৈরি হয়। এই তেল রান্না, ভাজা বা বেকিংয়ের জন্য ব্যবহূত হয়। পুষ্টির উৎসহিসেবে ভোজ্য তেল মানবশরীরের জন্য অপরিহার্য। মানবশরীরে শক্তি উত্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি উেসর মধ্যে তেল একটি। একজন সুস্থ মানুষের জন্য প্রতিদিন তার খাবারের ৩০ শতাংশ ক্যালরি অথবা তার প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ দশমিক শূন্য থেকে ১ দশমিক ২ গ্রাম তেল বা লিপিড গ্রহণ করা উচিত। গাছ, ফুল বা শস্য থেকে যে তেল আসে, সেটা উদ্ভিজ্জ তেল। একে পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটও বলা হয়। আর বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত উদ্ভিজ্জ তেল বা লিপিডের উেসর মধ্যে রয়েছে সয়াবিন, সরিষা, ক্যানোলা, জলপাই, রাইস ব্র্যান, সূর্যমুখী, ভুট্টার তেল ইত্যাদি।
শর্করা ও আমিষ ছাড়াও তেল বা চর্বি (লিপিড) হলো একজন মানুষের দৈনিক খাদ্যতালিকার অপরিহার্য অংশ। খাবারের তেলে রয়েছে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালোরি, ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিনস ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা শরীরের নানা ধরনের পুষ্টিস্বল্পতা পূরণ করে থাকে। শুধু শক্তি উত্পাদনই নয়, লিপিড দেহের বিভিন্ন অঙ্গের সুরক্ষায় অংশগ্রহণ করে, দৈহিক বিপাকে অংশ নেয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো লিপিড বায়োমেমব্রেনের অপরিহার্য উপাদান। উদ্ভিজ্জ তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড ছাড়াও মনো ও পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকার কারণে এটি ভোজ্য তেল হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘এ’, ‘ডি’, ‘ই’, ‘কে’ ফ্যাট সলিবল। এজন্যই বলা হয়, শাকসবজি বা অন্যান্য খাবারের প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ পেতে হলে অবশ্যই সেগুলো তেল দিয়ে রান্না করতে হবে।
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ ভোজ্য তেল যেমন—সানফ্লাওয়ার অয়েল, সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, রাইস ব্র্র্যান অয়েল, বাটার ওয়েল ইত্যাদি প্রচলিত থাকায় রান্নার জন্য কোন তেল ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী হবে তা নির্ধারণ করা বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। যেহেতু তেলের মধ্যে বিদ্যমান চর্বির ধরন ও পরিমাণ বিভিন্ন উত্সভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়, সেহেতু ভোজ্য তেল নির্বাচনের আগে অবশ্যই এর চর্বির ধরন ও পরিমাণ সম্পর্কে জানতে হবে।
তেলে সাধারণত স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বিদ্যমান। স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড মানবশরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়। স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডসমূহ সাধারণত প্রাণিজ উত্স থেকে আসে। অন্যদিকে, আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড কক্ষ তাপমাত্রায় তরল হয়। এটি ভালো কোলেস্টেরল এইচডিএল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। যদি কেউ হূদেরাগের ঝুঁকি কমাতে চান, তাহলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিবর্তে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণ করতে পারেন। এটি খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল কমাতেও সাহায্য করে। আনস্যাচুরেটেড আবার পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (পিইউএফএ) যেমন—সানফ্লাওয়ার অয়েল, সয়াবিন তেল ও মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (এমইউএফএ) যেমন—অলিভ অয়েল, সরিষার তেল নিয়ে গঠিত। পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট আবার ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডে বিভক্ত। কিছু ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীর নিজের দ্বারা তৈরি করতে পারে না, যার জন্য খাদ্যতালিকায় এটি আলাদাভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
এখানে উল্লেখ্য, এলডিএল কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে এইচডিএল কোলেস্টেরল। এইচডিএলের কণাগুলো রক্তের মাধ্যমে শিরায় ঘুরে ঘুরে ধমনীর দেওয়ালে লেগে থাকা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কণা ও এলডিএলকে রক্তে দ্রবীভূত করে ফেলে। এইচডিএল কোলেস্টেরলের ঐ সব ক্ষতিকারক উপাদানকে যকৃতে নিয়ে রিসাইকেল করে। তাই খাদ্যতালিকায় আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ ভোজ্য তেল ব্যবহার করতে হবে। রান্নার জন্য তেলে বিদ্যমান ফ্যাট সম্পর্কে ধারণা রাখার পাশাপাশি তেলের ওপর তাপমাত্রার প্রভাব সম্পর্কে জেনে রাখা জরুরি। উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করার পদ্ধতি (ফ্রাই, ডিপ ফ্রাই) তেলের অভ্যন্তরীণ ভাঙন ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল নির্গমন করে। অন্যদিকে হালকা ফ্রাই, বারবিকিউ বা রান্নার জন্য কম পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ অয়েল যেমন—অলিভ অয়েল, রাইস ব্র্যান অয়েল, ক্যানোলা অয়েল ব্যবহার করা ভালো। এগুলো উচ্চ তাপমাত্রায় স্থিতিশীল।
এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তেলের স্মোক পয়েন্ট। অর্থাত্ যে তাপমাত্রায় তেল পুড়ে ফ্যাটগুলো ভেঙে যায়, তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই কতক্ষণ ধরে রান্না হচ্ছে, সেটা বেশ জরুরি। যেমন :আজকাল অনেকেই স্বাস্থ্যসচেতনতায় অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল খেয়ে থাকেন। কিন্তু অলিভ অয়েলের স্মোক পয়েন্ট অনেক কম হওয়ায় ভাজাপোড়ার ক্ষেত্রে এই তেল উলটো ফল দিতে পারে। অলিভ অয়েল দিয়ে ১৭ মিনিটের বেশি সময় ধরে রান্না করা ঠিক নয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত বেশির ভাগ খাবার রান্না করতে এর চাইতে অনেক বেশি সময় লাগে। ফলে তেল তার কার্যকারিতা হারায়। তাই অলিভ অয়েল খেতে হলে সেটা খাবারে সরাসরি মিশিয়ে খেতে হবে—যেমন সালাদের ড্রেসিংয়ে কিংবা খাবার অল্প আঁচে দ্রুত রান্না করে ফেলতে হবে।
এক্ষেত্রে বেশি সময় ধরে রান্নার জন্য উপযোগী হলো অন্যান্য ভার্জিন বা রিফাইন্ড তেল। এগুলোর স্মোক পয়েন্ট তুলনামূলক বেশি থাকে। সরিষার তেল, সয়াবিন তেল বা বাজারে প্রচলিত অন্যান্য তেল রান্নার সময় সহজে ভেঙে যায় না। সম্প্রতি রান্নার জন্য নারিকেল তেলকে বলা হয়েছিল সুপার ফুড। তবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এই তেলকে ‘খাঁটি বিষ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কারণ নারিকেল তেলের ৯০ শতাংশই স্যাচ্যুরেটেড ফ্যাট।
আবার পোড়া তেল শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। কারণ বারবার তেল পুড়লে নতুন বিক্রিয়ায় রাসায়নিক গঠন পরিবর্তিত হয়ে ইউরিক অ্যাসিডসহ বহু বিষাক্ত উপাদান তৈরি হয়, যা থেকে হার্টের ক্ষতি হতে পারে। ব্রিটেনের ডি মন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের লেস্টার স্কুল অব ফার্মাসি এক গবেষণা চালিয়ে দেখেছে, উচ্চ তাপমাত্রায় (১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি) রান্না করলে তেল-চর্বিতে থাকা অণুর গঠন বদলে যায়। বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বা অক্সিডেশন হয়। সেখান থেকে উত্পন্ন হয় অ্যালডিহাইডস ও লিপিড পার অক্সাইড। অ্যালডিহাইডস নিশ্বাস বা খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে গ্রহণ করলেও সেটা হূদেরাগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাওয়ার উপযোগী তেল বাছাইয়ের আগে বাংলাদেশের বর্তমান ভোজ্য তেল পরিস্থিতি, বিশ্ববাজারের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করা জরুরি। আমাদের দেশে তেল ফসলের মধ্যে সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তিসি, সয়াবিন, সূর্যমুখী প্রভৃতি চাষ হয়ে থাকে। দেশে ভোজ্য তেলের বাত্সরিক চাহিদার ৮০-৮৫ ভাগই আমদানিনির্ভর। আমদানিকৃত সয়াবিন, পাম, ক্যানোলা ও সূর্যমুখী তেল দ্বারা এই চাহিদা পূরণ করা হয়। আমদানিনির্ভর ৯০ শতাংশই পাম ও সয়াবিন তেল। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে সয়াবিন, পাম, সরিষা ও রাইসব্র্যান তেল মিলিয়ে দেশে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। চাহিদার বেশির ভাগ, অর্থাত্ ১৩ লাখ টনই পাম তেল এবং ৫ লাখ টন সয়াবিন তেল। আরেকটি বড় সমস্যা হলো, বেশি মুনাফার আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সয়াবিন তেলের সঙ্গে পাম তেল মিশিয়ে বিক্রি করার প্রবণতা, যা ভোক্তাসাধারণের জন্য পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে।
এই অবস্থায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরিষার তেলের বিশেষ গুরুত্ব ও উপযোগিতা রয়েছে। সরিষার তেলের মনো আনসেচুরেটেড এবং পলি আনসেচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকায় এই তেল সেবনে রক্তে এইচডিএল (ভালো কোলেস্টেরল) বাড়তে থাকে এবং এইচডিএল (খারাপ কোলেস্টেরল)-এর পরিমাণ কমতে থাকে। এছাড়া রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরিষার তেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরিষার তেলে বিদ্যমান গ্লুকোসিনোলেট নামের মেটাবোলাইট বিশ্লেষিত হয়ে আইসোথায়োসায়ানেট তৈরি হয়, যা ক্যানসার কোষ গঠনে বাধা দেয়।
সরিষার তেল গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘ইরুসিক অ্যাসিড’ বিষয়ে বেশ মতভেদ রয়েছে। ১৯৭০ সালের দিকে ইঁদুরের শরীরে গবেষণার ফলাফল গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ মানবশরীরে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরিষার তেল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীকালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের তত্ত্বাবধানে বিশদ গবেষণার পর ২০১৬ সালে ২ শতাংশ পর্যন্ত ‘ইরুসিক অ্যাসিড’কে গ্রহণযোগ্য বলে মতামত প্রদান করা হয়। পক্ষান্তরে ইন্ডিয়ান লিপিড অ্যাসোসিয়োশন তাদের গবেষণায় প্রমাণ করে ও ঘোষণা করে যে, সরিষার তেলই হলো মানবশরীরের জন্য সবচেয়ে উপকারী তেল। এছাড়া অতি সম্প্রতি নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজঅর্ডারের বিরুদ্ধে ইরুসিক অ্যাসিডের উপকারী দিকসমূহ প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া, ইরুসিক অ্যাসিড অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিভাইরাল হিসেবে, পেশিতে গ্লুকোজ গ্রহণের মাধ্যমে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সমস্যার সমাধানে, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে, কিছু ওষুধের বাহক উপাদান হিসাবেও ভূমিকা পালন করে।
এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কোনোভাবেই আমাদের নির্দিষ্ট কোনো একটি তেলের ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। যেহেতু সরিষার তেলের ইরুসিক সম্পর্কে এখনো বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান, সেহেতু কম ইরুসিক অ্যাসিড সম্পন্ন সরিষার জাত উদ্ভাবন জরুরি। এক্ষেত্রে ক্যানোলা জাত উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দেশীয় জার্মপ্লাজমের স্বল্পতা বিবেচনায় ক্যানোলা জাত উদ্ভাবনে মিউটেশন ব্রিডিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া প্রচলিত সরিষার জাত উন্নয়নে জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির ব্যবহার করেও ইরুসিক অ্যাসিডের পরিমাণ কমানো সম্ভব। তাই সব দিক বিবেচনা করে এটি বলা যায় যে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট, বৈশ্বিক তেলের বাজার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, দেশে তেলের বর্তমান উত্পাদন ইত্যাদি সামনে রেখে অদূর ভবিষ্যতের জন্য আমাদের সরিষার তেলকেই খাবার তেল হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।