সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক কোম্পানিগুলোর নাম আংশিক পরিবর্তন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত বিআরপিডি সার্কুলার নম্বর ০৪ জারি করে বাংলাদেশে কার্যরত সব তফসিলি ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। ঐ সার্কুলারের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর ১১ ক (ক) ধারার বিধান অনুসারে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত সীমিতদায় পাবলিক ব্যাংক কোম্পানির নামের শেষে ‘পাবলিক সীমিতদায় কোম্পানি’ বা ‘পিএলসি’ লিখতে হবে। খুব সহজ করে বললে, যেসব ব্যাংকের নামের শেষে ‘লিমিটেড’ শব্দটি আছে, ঐসব ব্যাংক ‘লিমিটেড’ শব্দটি বাদ দিয়ে নামের শেষে ‘পাবলিক সীমিতদায় কোম্পানি’ বা সংক্ষেপে ‘পিএলসি’ লিখবে। কোম্পানি আইনের উপরি উক্ত বিধান পরিপালন করতে ব্যাংক কোম্পানির নাম ও মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন বা সংঘস্মারক পরিবর্তন করতে হবে। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আইনানুগ আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের জন্য বিআরপিডি সার্কুলারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোম্পানিগুলোকে প্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে।
মূলত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে সংক্ষেপে পিএলসি এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিকে এলটিডি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এই দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মৌলিক পার্থক্য হলো প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার সহজে হস্তান্তরযোগ্য নয়, ব্যক্তিগতভাবে তা ক্রয়-বিক্রয় হতে পারে সাধারণ মানুষ এর শেয়ার ধারণ করতে পারে না। অন্যদিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার সহজে ক্রয়-বিক্রয় করা যায় এবং সাধারণ মানুষ এর শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক তাদের নামের শেষে লিমিটেড শব্দটি ব্যবহার করে। লিমিটেডকে অনেক সময় এলটিডি দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অর্থাত্ এটি প্রাইভেট কোম্পানি। বিশেষজ্ঞগণ তাই মনে করেন আমাদের দেশের ব্যাংকের নামের সঙ্গে লিমিটেড শব্দ ব্যবহার বহুলপ্রচলিত একটি ভুল।
বিশ্বের অনেক দেশের ব্যাংকের নামের শেষে সংশ্লিষ্ট দেশের নিজস্ব ভাষায় অথবা ইংরেজিতে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি লেখা হয়। যেমন জার্মানির ব্যাংকের নামের শেষে জিএমবিএইচ (GmbH) লেখা হয় যার জার্মানি ভাষায় অর্থ হচ্ছে ‘Gesellschaft mit beschränkter Haftung’ বা ইংরেজিতে ‘Company with Limited Liability.’ সিঙ্গাপুরের ব্যাংকগুলোর নামের শেষে LLC অর্থাত্ ‘Limited Liability Company’ বা ‘Company with Limited Liabilit’ উল্লেখ করা হয়। মালয়েশিয়ান ব্যাংকগুলোর নামের শেষে Berhad (BHD) যার অর্থ private limited company উল্লেখ করা হয়।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে তপশিলি ব্যাংক, অর্থাত্ বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে ছয়টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ৯টি বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক। কোম্পানি আইনের এই নতুন বিধান পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে বাংলাদেশে নিবন্ধিত সব সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণেই ব্যাংক কোম্পানির নাম পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়েছে। কোম্পানি (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন, ২০২০ জারির মাধ্যমে ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন ও কয়েকটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে। ‘সীমিতদায় কোম্পানি শনাক্তকরণ’ সংক্রান্ত একটি নতুন ধারা যোগ করা হয়েছে (ধারা ১১ ক)। ঐ ধারার বিধান মোতাবেক সীমিতদায় পাবলিক কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানির নামের শেষে ‘পাবলিক সীমিতদায় কোম্পানি’ বা ইংরেজিতে ‘পিএলসি’ লিখতে হবে [ধারা ১১ ক (ক)]। ‘পিএলসি’ হচ্ছে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির সংক্ষিপ্ত রূপ। অন্যদিকে, ১১ ক (খ) ধারায় বলা হয়েছে, সীমিতদায় প্রাইভেট কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানির নামের শেষে ‘সীমিতদায়’ বা ইংরেজিতে ‘এলটিডি’ লিখতে হবে। আর এক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানির নামের শেষে ‘এক ব্যক্তি কোম্পানি’ বা ইংরেজিতে ‘ওয়ান পারসন কোম্পানি’ বা সংক্ষেপে, ‘ওপিসি’ লেখার বিধান কোম্পানি আইনে সংযোজন করা হয়েছে [ধারা ১১ ক (গ)]। এক ব্যক্তি কোম্পানি গঠন, নিবন্ধন ও পরিচালনাসংক্রান্ত একটি নতুন খণ্ড (দশম-ক) কোম্পানি আইনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
কোম্পানি আইনের বিধান অনুসারে, কোনো কোম্পানি বিশেষ সিদ্ধান্তক্রমে কোম্পানির নাম পরিবর্তন করতে পারে। তবে নাম পরিবর্তনের বিষয়ে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের (আরজেএসসি) অনুমোদন প্রয়োজন হয় [ধারা ১১ (৬)]। এ ক্ষেত্রে নিজ নিজ ব্যাংকের বিশেষ সাধারণ সভায় ব্যাংক কোম্পানির নাম পরিবর্তন ও তদনুযায়ী সংঘস্মারকে নাম পরিবর্তনের বিষয়ে বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে; বিশেষ সিদ্ধান্তের অনুলিপি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তিপত্রসহ আরজেএসসি বরাবর আবেদন করতে হবে। কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর ধারা ১১ (৭) মোতাবেক আরজেএসসি নিবন্ধন বইয়ে কোম্পানির নতুন নাম লিপিবদ্ধ করবেন এবং পরিবর্তিত নামে সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন বা নিবন্ধনপত্র ইস্যু করবেন। সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন প্রদানের পর কোম্পানির নাম পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সমাপ্ত হবে।
বাস্তবতা হচ্ছে—ব্যাংকের নামের শেষে পিএলসি যুক্ত করার ফলে নতুনভাবে একটি ব্যাংকের সুমান বৃদ্ধি বা হ্রাস, উন্নত বা অনুন্নত প্রকাশ পায় না বা গ্রাহকদের আস্থা হ্রাস বা বৃদ্ধি কোনো কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে না। সম্প্রতি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সরকার ও বেসরকারি ব্যাংকের নামের শেষে পিএলসি যুক্ত করা হয়েছে যা শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ পরিপালনের জন্য।