আমদানি খরচ বাড়ছে, রপ্তানি আয় কমছে। অনেকে সুযোগ বুঝে মুনাফার আশায় ডলার মজুত করে রাখেন। এতে দেশে মার্কিন ডলারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে। দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়লেও তা ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে ডলারের দাম। এজন্য বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি বেশ কিছু পদক্ষেপও নেয় সংস্থাটি। এছাড়া ঈদুল আজহা উপলক্ষে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। এদিকে, আমদানিকারকরা ডলারের অভাবে ঋণপত্র খুলতে গিয়ে বিপদে পড়ছেন। বিএসআরএম, পিএইচপি ইন্টেগ্রেটেড স্টিল কোম্পানির মতো অনেক কোম্পানি বারবার ব্যাংকগুলোতে ধরনা দিয়েও ঋণপত্র খুলতে পারছে না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ডলারের দাম কোন পর্যায়ে যাবে তা বলা মুশকিল। তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে ডলারের সমস্যা আরো প্রকট হবে বলে মনে করছেন তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে প্রথম ৩৯ বছরে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয়েছে, তা পরের ১০ বছরেই বেড়ে আড়াই গুণে দাঁড়িয়েছে। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে নেয়া বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হবে। সরকারকে এ ঋণের কিস্তি ডলারে পরিশোধ করতে হবে। ফলে রিজার্ভ সংকট আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে আনার সুযোগও এ সংকট প্রকট করতে পারে বলে মনে করেন তারা।
দেখা গেছে, একদিকে অর্থনীতির নানামুখী সমস্যা রিজার্ভ সংকট সৃষ্টি করেছে, আবার রিজার্ভ সংকট অর্থনীতির অন্যান্য সমস্যাকে তীব্রতর করছে। ইতোমধ্যে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ১২ দফা বাড়ানো হয়েছে ডলারের দাম। বর্তমানে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৯৩ দশমিক ৩৯ টাকা। এটি মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত কাগুজে হার। তবে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করছে ৯৮-৯৯ টাকা দরে। এর আগে মে মাসে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়েছিল।
গত ২৯ মে দেশে ডলারের দর ৮৯ টাকা বেঁধে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ডলারের ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। তখন কয়েক দফা বেড়েছে ডলারের দাম। আর ডলার সংকটে এলসি মূল্য পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক। বিশেষ করে ছোট ব্যাংকগুলোতে সবচেয়ে বেশি ডলার সংকট রয়েছে। ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে বিড়ম্বনায় পড়ছে ব্যাংকগুলো। তবে যেসব ব্যাংকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেশি তাদের কাছে পর্যাপ্ত ডলার আছে। এর বিপরীতে পর্যাপ্ত রেমিট্যান্স না আসায় ডলার সংকটে পড়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো। বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান জানান, দেশে এখন আমদানির জন্য যে পরিমাণ অর্থ বা ডলার খরচ হচ্ছে, তা রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে মিটছে না। এর ফলে সংকট তৈরি হয়েছে।
এ জন্য বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ ডলার বিক্রি করছে, সেটি চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। ফলে প্রতি মাসে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
এদিকে, ঈদের আগে ডলারের প্রয়োজন মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের শরণাপন্ন হতে দেখা গেছে অনেক ব্যাংককে।তাতেও সংকট কাটেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে কিছু ব্যাংক। কিন্তু আবেদন করেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনেক ব্যাংক ডলার পাচ্ছে না, এমন অভিযোগও রয়েছে। বিষয়টি অবহিত করার জন্য গভর্নরের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছে একটি ব্যাংক। যদিও সম্প্রতি দেশে কুরবানির ঈদ কেন্দ্র করে পশুসহ প্রয়োজনীয় অন্য কেনাকাটা করতে অন্যবারের মতো এবারো পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সে কারণে রেমিট্যান্সও এসেছে বেশি। ঈদের ছুটির আগে সাত দিনেই ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আর প্রবাসী আয়ের এ জোয়ারের কারণে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামার যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা নামেনি। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পরও রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে অবস্থান করছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে এখন ডলারের চাহিদা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দর বেড়েছে। সংকটও তৈরি হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, যেসব ব্যাংকের রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় ভালো, তারা অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু যাদের রেমিট্যান্স কম, তারা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর কাছ থেকে প্রায় ১০০ টাকায় ডলার কিনছে।
করোনা পরবর্তীতে হঠাৎ করে বাড়তি চাহিদার কারণে ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এর ফলে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। কিন্তু যে হারে আমদানি ব্যয় বেড়েছে
সে হারে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়েনি। এছাড়া করোনার সময়ে বৈদেশিক ঋণ ও এলসির স্থগিত দেনা এখন শোধ করতে হচ্ছে- যে কারণে ডলারের চাহিদা বেশি বলে জানান এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, ডলারের দাম ওঠানামা করে ডিমান্ড এন্ড সাপ্লাই বেইজে। যদি হঠাৎ করে ডিমান্ড আরো বেড়ে যায়, তবে দাম আরো বাড়বে। ডিমান্ড কমলে দামও কমবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছিল ডলারের চাহিদা কমাতে। তাতে ওভার অল আমদানির ডিমান্ড একটু কমেছে। এছাড়া বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। এগুলোর প্রভাবেও স্থিতিশীল রয়েছে ডলার বাজার। তবে মনে হচ্ছে, যে পর্যায়ে আছে তা হয়তো স্ট্যাবল পর্যায়ে আছে।
তিনি আরো বলেন, ডলারের চাহিদা বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, করোনাপরবর্তী ঘুরে দাঁড়ানোর পর আমাদের আমদানিকৃত পণ্যে ৩০-৪০ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। অর্থাৎ এখানে প্রাইজ কম্পোনেন্ট হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের ট্রেড ভলিউম বেড়েছে। ইমপোর্ট ভলিউম বেড়েছে। কেননা আমরা রপ্তানি করছি বেশি। আর রপ্তানি পণ্যের কাঁচামালের একটি বড় অংশই আমরা আমদানি করে থাকি। এরপর আছে মূল্যস্ফীতি। তিনি বলেন, শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আমাদের প্রবাসী আয়ও কমেছে গত বছরের তুলনায়। ফলে একটি বড় গ্যাপ তৈরি হয়েছে। এ গ্যাপ ম্যানেজ করতে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ডলারে তেমন প্রভাব পড়ছে না বলেও মনে করেন এ ব্যাংকার। তিনি বলেন, বৈদেশিক ঋণ বাড়ছে। আমরা অনেকগুলো বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। তবে বৈদেশিক ঋণের সুদহার খুবই কম। সুতরাং তাতে তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে বলে মনে হয় না। আসলে আামদের টাকাও অনেক বছর ধরে ওভারভ্যালুড (অতিমূল্যায়িত) ছিল।
এটা গত ৩-৪ বছরে ডিভ্যালু (অবমূল্যায়িত) করা হতো, তাহলে এক ধাক্কায় এত ডিভ্যালুয়েশন হতো না, যেটা গত ২-৩ মাসে হয়েছে।
ডলারের চাহিদা কমাতে রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এ কারণে রিজার্ভ সংকট তীব্রতর হচ্ছে। গত ২৭ জুন কয়েকটি ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হয় ৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করেছে ৭৪৩ কোটি ডলার।
সংকট কাটাতে উদ্যোগ : ডলার সংকট মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করা ছাড়াও বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা, কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বাতিল করা হয়। এছাড়া রপ্তানি আয় আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর মনোযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়ানোর ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে তাগিদ দেয়া হয়। সম্প্রতি সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের নির্দেশ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগের পরিপত্রে বলা হয়, এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিলের অর্থে বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ থাকবে। এছাড়া কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বিলাস পণ্য আমদানিতে ৭৫ শতাংশ এলসি মার্জিন রাখতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়, এমন পণ্যের নগদ মার্জিন নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ৫০ শতাংশ।
এছাড়া আয় বাড়াতে বিদেশ থেকে ডলার আনার প্রক্রিয়া উদার করে দিয়েছে সরকার। ফলে প্রবাসী আয় বাবদ দেশে যত পরিমাণ ডলার পাঠানো হোক না কেন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো। আবার এর বিপরীতে আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনাও দেয়া হবে। আগে বিদেশ থেকে পাঁচ হাজার ডলার বা পাঁচ লাখ টাকার বেশি আয় পাঠাতে আয়ের নথিপত্র জমা দিতে হতো।