বাংলাদেশ যেভাবে উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত হচ্ছে এই অবস্থায় আগামী দিনে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের প্রচুর পরিমাণে পুঁজির প্রয়োজন হবে। ব্যাংকিং সেক্টর সেই পুঁজির জোগান দিতে পারবে না। তাই আমাদের শেয়ার বাজারের ওপর নির্ভরতা বাড়াতেই হবে। দেশের ব্যক্তি খাতে যেসব বড় কোম্পানি আছে তাদের পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এটা স্বীকার করতে হবে যে, কোনো কাজে সর্বোত্তম সাফল্য অর্জন করতে হলে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণ মানুষের সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে। মানুষের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করে। প্রশিক্ষণ ব্যতীত কখনোই দক্ষতার উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব নয়। পুঁজিবাজারের মতো সংবেদনশীল একটি খাতের জন্য প্রশিক্ষণের গুরুত্ব আরো বেশি। এই সত্য উপলব্ধি করেই বাংলাদেশ সরকার ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট বা বিআইসিএম প্রতিষ্ঠা করে। এর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০১০ সালে। বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু উন্নয়ন অর্জন করলেই চলবে না। সেই উন্নয়ন যাতে টেকসই এবং সমতাভিত্তিক হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
একটি দেশ কখনোই সত্যিকার উন্নয়ন অর্জন করতে পারে না, যতক্ষণ ব্যক্তি খাত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিকশিত না হয়। শিল্পায়নের মাধ্যমে ব্যক্তি খাত বিকশিত হতে পারে। ব্যক্তি খাতে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য প্রচুর পরিমাণে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের উদ্যোক্তাগণ সব সময়ই পুঁজি স্বল্পতায় ভোগেন। প্রয়োজনীয় পুঁজির জন্য তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ট্র্যাডিশনাল ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু ব্যাংক সব সময় উদ্যোক্তাদের চাহিদামতো পুঁজির জোগান দিতে পারে না। এছাড়া ব্যাংকিং সেক্টর খেলাপি ঋণ সমস্যাসহ নানা ধরনের জটিলতার জর্জরিত থাকার ফলে তাদের পক্ষে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের সেভাবে সহায়তা করা সম্ভব হয় না। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য পুঁজির সংস্থানের জন্য সবচেয়ে উপযোগী স্থান হচ্ছে পুঁজিবাজার।
উন্নত দেশগুলোতে সাধারণত ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করা হয় না। স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করা হয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে। পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ সংগ্রহের সুবিধা হচ্ছে বছর শেষে কোম্পানি মুনাফা অর্জন করলেই শুধু ডিভিডেন্ড দিতে হয়। আর ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলে মুনাফা হোক আর না-ই হোক সুদসমেত ঋণের কিস্তি ফেরত দিতে হয়। আমাদের মতো দেশে আরো একটি জটিল সমস্যা হচ্ছে, অধিকাংশ সময়ই গৃহীত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত হয় না। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলেও ব্যাংকের ঋণ সুদসহ ঠিকই ফেরত দিতে হয়। বাংলাদেশ যেভাবে উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত হচ্ছে এই অবস্থায় আগামী দিনে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের প্রচুর পরিমাণে পুঁজির প্রয়োজন হবে। ব্যাংকিং সেক্টর সেই পুঁজির জোগান দিতে পারবে না। তাই আমাদের শেয়ার বাজারের ওপর নির্ভরতা বাড়াতেই হবে। দেশের ব্যক্তি খাতে যেসব বড় বড় কোম্পানি আছে তাদের পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পুঁজিবাজারের সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে বাজারে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের জোগান বৃদ্ধি ব্যতীত কোনো গত্যন্তর নেই। আর সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ, বিশেষ করে যারা স্বল্পপুঁজির মালিক তাদের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের জন্য উত্সাহিত করতে হবে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আসবেন তাদের আগে থেকেই বাজারের স্বভাব এবং গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে আসতে হবে। পুঁজিবাজার সম্পর্কে মৌলিক এবং প্রাথমিক ধারণা না থাকলে এখানে সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু আমাদের এখানে যারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আসেন তাদের বেশির ভাগই অন্যের পরামর্শে বিনিয়োগ করেন। পুঁজিবাজার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও ধারণা দেওয়ার জন্যই বিআইসিএম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ অত্যন্ত লাভজনক। প্রয়োজন শুধু জেনেশুনে ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে কীভাবে লাভবান হওয়া যায়, কীভাবে ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয়, গুজবে প্রভাবিত না হয়ে কীভাবে সঠিক শেয়ারে বিনিয়োগ করা যায়—এসব মৌলিক বিষয় আমাদের প্রশিক্ষণ কোর্সের মাধ্যমে শেখানো হয়। পুঁজি বাজারের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে যারা বিনিয়োগ করতে আসেন তাদের ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়। এখানে আরো একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, প্রশিক্ষণ শুধু বিনিয়োগকারীরা গ্রহণ করলেই চলবে না, যারা বাজারে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেন তাদেরও প্রশিক্ষিত করার প্রয়োজন রয়েছে। বিনিয়োগকারী ও মধ্যস্থতাকারী যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত হন তাহলে তাদের পক্ষে বাজারে ভালোভাবে টিকে থাকা সম্ভব। তারা বুঝতে পারবেন কখন কোন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি কম থাকবে এবং মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে দেশের শেয়ার বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে। সেই বিপর্যয়ের পেছনে গুজব একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। সেই সময় যারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতেন তাদের অধিকাংশই বাজারের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে না জেনেই মানুষের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিনিয়োগ করতেন। এমনও দেখা গেছে, প্রকল্প তখনো চালু হয়নি অথচ বাজারে সেই কোম্পানির শেয়ার পাঁচ-ছয় গুণ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের বুঝতে হবে, বাজারে একটি কোম্পানির শেয়ার যত টাকায় বিক্রি হোক না কেন, চূড়ান্ত পর্যায়ে শেয়ারের অভিহিত মূল্যের ওপরই ডিভিডেন্ড দেওয়া হবে। যে কোম্পানি এখনো উত্পাদন শুরু করেনি, সেই কোম্পানি ডিভিডেন্ড দেবে কী করে?
সেই সময় যেসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন তারা যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং বাজারের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হতেন, তাহলে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকত। সেই সময় অনেকেই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে এসে নিঃস্ব হয়েছেন। কেউ কেউ সব কিছু হারিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ার বাজার বিপর্যয়ের পরই মূলত পুঁজিবাজারে বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। এই সংস্কারের অংশ হিসেবেই বিআইসিএম প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের ওপর জোর দেওয়া হয়। এজন্য আইন তৈরি করা হয়। ২০১০ সালের পর শেয়ার বাজারে মাঝেমধ্যে উত্থানপতন ঘটলেও বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় সৃষ্টি হয়নি। এখন যারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করছেন তারা আগের চেয়ে অনেকটাই সচেতন। ক্যাপিটাল মার্কেট, মানি মার্কেট, ফিন্যান্সিয়াল মার্কেট ইত্যাদি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্যই বিআইসিএম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বর্তমানে দেশের শেয়ার মার্কেটে যে সংকট চলছে তা মূলত আস্থার সংকট। তাই আমাদের প্রথমেই শেয়ার বাজারের ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যারা শেয়ার বাজার নিয়ে কাজ করছেন, বিশেষ করে গবেষক আছেন, তাদের খুঁজে বের করতে হবে—শেয়ার বাজারের ওপর আস্থার সংকট কেন সৃষ্টি হয়েছে। শেয়ার বাজারসংশ্লিষ্ট সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সংকট সমাধানের জন্য চেষ্টা চালাতে হবে।
ব্যক্তিখাতের সম্ভাবনাময় কোম্পানিগুলোকে আইপিওতে (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) নিয়ে আসার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুন নতুন কোম্পানি যাতে সহজেই পুঁজিবাজারে আসতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনকে আরো সহজীকরণ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তাদের পর্যায়ক্রমে শেয়ার বাজারে নিয়ে আসতে হবে।
বিআইসিএমের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য শেয়ার বাজারে আসতে চায় না। তারা মনে করে, শেয়ার বাজারে গেলে নানা ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি হতে পারে। ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তাদের অনেকেই মনে করেন, শেয়ার বাজারে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে কোম্পানির ওপর থেকে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়া। নানা ধরনের জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। আইনি জটিলতা সৃষ্টি হবে। তার চেয়ে বরং শেয়ার বাজারে না যাওয়াই ভালো। তাদের বোঝাতে হবে, ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের চেয়ে বাজারে কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করা অধিকতর লাভজনক।
সুতরাং দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জন্য ব্যাংক নয়, পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে বসে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীকরণের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে আগামীর দিনে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাগণ ব্যাংকের পরিবর্তে শেয়ার বাজার থেকে তাদের চাহিদাকৃত পুঁজি সংগ্রহ করার জন্য উদ্যোগী হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে পত্রপত্রিকায় নানা ধরনের নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরও শেয়ার বাজারের মতো সংবেদনশীল। কিছুদিন আগে ব্যাংকিং সেক্টর দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে—এ ধরনের একটি গুজব চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সেই সময় মাত্র কিছু দিনের মধ্যেই ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছিল বলে দায়িত্বশীল কোনো কোনো সূত্র দাবি করেছিল। এমন অবস্থার যাতে আর সৃষ্টি না হয়, সেদিকে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে।