পৃথিবীব্যাপী জনজীবনকে বিপর্যস্তকারী এ বছরের তাপপ্রবাহ বাংলাদেশও অনুভব করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসা ১৮৮০ সাল থেকে উষ্ণতম মাসগুলোর হিসাব রেখে আসছে এবং তাদের হিসাবে এ বছরের জুলাই মাসটি ছিল রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণ মাস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস ও জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থাও বলছে, সব রেকর্ড ভেঙে বিশ্বের উষ্ণতম মাস হয়েছে এ বছরের জুলাই। জাতিসংঘ মহাসচিবের কথায় উষ্ণায়নের যুগ পেরিয়ে বিশ্ব ফুটন্ত যুগে প্রবেশ করেছে। চীনে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়েছে। ইউরোপে ২০২২ সালে ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে দাবদাহে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এ বছরের এপ্রিল মাসে ২৪ দিন ও মে মাসে ২২ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে যায়—অবস্থা চরমে যাওয়ায় এমনকি জুন মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। ১৬ এপ্রিল, ২০২৩ ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল।
তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা মানুষের থাকলেও গরমের এ বাড়-বাড়ন্ত মানুষের শরীর তথা স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। যদিও বয়সভেদে তা ভিন্ন হয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। মানবশরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে, শরীর তখন ঠিকমতো কাজ করতে পারে। তবে তাপমাত্রা ২০-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আর্দ্রতার পরিমাণ ৬০ শতাংশ হলে তা সহ্যসীমার মধ্যে থাকে, এর চেয়ে বেশি হলে অস্বস্তি ও নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। তাপ ৪০ ডিগ্রিতে উন্নীত হলে সংজ্ঞাহীন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। উচ্চ তাপমাত্রা মস্তিষ্ক ও হূিপণ্ডের মাংসপেশির ক্ষতি করে, যা প্রাণঘাতী হতে পারে। ইউনিসেফ বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার ৭৬ শতাংশ শিশুর জীবন হুমকিতে আছে। এমন উচ্চ তাপের কারণে শিশুরা মানসিক বিকাশে বাধাসহ নানা শারীরিক রোগে ভুগতে পারে। বছরে ৮৩ দিন ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করলে এ ঝুঁকি তৈরি হয়। মানুষের শরীরে অতিরিক্ত গরমের প্রতিক্রিয়া জানতে এক পরীক্ষার অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন বিবিসির উপস্থাপক জেমস্ গ্যালাগ। ২১ থেকে ৪০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা বাড়ানোয় মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল, শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া মিনিটে ১০-১৫ বার বেড়ে গিয়েছিল, হূত্স্পন্দন ৫৪-৮৭ হচ্ছিল, শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ২ ডিগ্রি থেকে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি এবং ত্বকের তাপমাত্রা ৩১ দশমিক ৩ ডিগ্রি থেকে ৩৫ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে, স্মরণশক্তিও হ্রাস পায় এবং এক ঘণ্টার পরীক্ষায় ৪০০ মিলিলিটার ঘাম নিঃসারিত হয়।
নানা কারণে আমরা ঘরের বাইরে বেরোতে বাধ্য হই। তাই তাপপ্রবাহে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করা ও একজন আরেক জনের প্রতি যত্নবান হতে নানা পদক্ষেপের কথা আমাদের ভাবা দরকার। বাড়তি তাপমাত্রার নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেকে ও অন্যদের বাঁচার কৌশল জানা ও গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসবের মধ্যে আছে ছায়ায় অবস্থান করা, ঢিলেঢালা পোশাক পরা, ঘর শীতল রাখা, পর্যাপ্ত পানি পান করা, অপ্রয়োজনে বাইরে না হাঁটা ও দিনের উষ্ণ সময়ে ব্যায়াম না করা, সূর্যালোক থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা। কারণ রোদে সামান্য পুড়লেও ঘামার ক্ষমতা দুই সপ্তাহের জন্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে সায়েন্টিফিক আমেরিকান সাময়িকীতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আরো আলোচনা করা হয়েছে। গ্লোবাল আউটডোর ইমার্জেন্সি সাপোর্টের প্রধান চিকিৎসক গ্রান্ট লিপম্যান পানির সঙ্গে লবণযুক্ত হালকা খাবার বা পানীয় গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন। সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে অরক্ষিত থাকলে ত্বক ও চোখের ক্ষতি, রোগপ্রতিরোধক্ষমতাকে হ্রাস করতে পারে, ক্যানসার হতে পারে। এসব ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকতে রোদচশমা, চওড়া কানার টুপি ব্যবহার করা যায়। আমাদের যারা মাঠে কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকেন, তারা হারিয়ে যাওয়া একসময়ের বহুলব্যবহূত বাঁশ ও গাবগাছের পাতায় তৈরি মাথাল বা মাথাইল ব্যবহার করতে পারেন। চরম তাপমাত্রা আশ্চর্যজনকভাবে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য অবস্থা, যেমন—অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, মাইগ্রেন, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হূদেরাগকে বৃদ্ধি করতে পারে। বাড়ন্ত তাপমাত্রার সঙ্গে একটা সীমা পর্যন্ত খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা মানুষের আছে। শরীরের ঘাম নিঃসারণ অতিরিক্ত তাপকে বাধা দেয়। কিন্তু চরম তাপ ও আর্দ্রতায় অতিরিক্ত ঘাম নিঃসারণ শরীর লবণ ও ইলেকট্রোলাইট হারায়, যা মাংসপেশির কার্যকারিতায় দরকারী। এমন অবস্থা পা কিংবা পাকস্থলীর খিঁচুনি সৃষ্টি করে—এটা তাপজনিত অবসাদের প্রথম লক্ষণ। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মাথাধরা, বমনেচ্ছা ও বমির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। তবে হিটস্ট্রোকের অতি চরম অবস্থায় অস্থিরতা ও মানসিক বিকার বা প্রলাপের লক্ষণ দেখা দেয়, এমনকি জ্ঞান হারাতেও পারে। তবে লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিন্তু প্রকাশ পায় হঠাৎ করে। এমন অবস্থায় ৩০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে যেতে অথবা কমপক্ষে শীতল করতে না পারলে স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যেতে পারে—যেমন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। তাপ সহ্য করার ক্ষমতায় মানুষে মানুষে পার্থক্য আছে। একই তাপে মানুষ ভিন্নভাবে সাড়া দিতে পারে—তবে তা বয়স, স্বাস্থ্যগত অবস্থা, উচ্চ তাপমাত্রার পরিবেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারগুলো অন্যতম। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ম্যাথুউ লেভি বলেন, দীর্ঘক্ষণ চরম তাপমাত্রায় অনাবৃত অবস্থা অসুস্থতার বেশি ঝুঁকি তৈরি করে। তাপ অবসাদে বা স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা গেলে শরীরের তাপমাত্রা হ্রাসের জন্য নিজেকে বা আক্রান্ত ব্যক্তিকে ছায়াতলে অর্থাত্ শীতল স্থানে নিতে হবে। ত্বক ভেজানো, ঠান্ডা পানি দিয়ে পরিধেয় বস্ত্র ভেজানো, ঠান্ডা পানির স্নান ইত্যাদি শীতলীকরণের অন্যান্য পদ্ধতি; তবে ঠান্ডা পানিতে ডুব দেওয়া সর্বোত্তম কার্যকর পদ্ধতি। ঘরকে বাইরের তাপ থেকে বাঁচাতে দিনের বেলায় ঘরের পর্দা টেনে রাখা। চরম তাপ সবাইকে আক্রান্ত করলেও কেউ কেউ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যাদের মধ্যে আছেন বয়স্ক, শিশু, দীর্ঘস্থায়ী অসুখে ভোগা লোকজন এবং যারা বাইরে অত্যাবশ্যকীয় কাজ করেন। আগে যাদের মানসিক সমস্যা ছিল না, চরম তাপ এমন মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভীতিকর একটি দৃশ্য হলো চরম তাপ। বাংলাদেশেও গত কয়েক বছর ধরে দাবদাহ বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে এবং তা উদ্বেগজনক। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সিসিলিয়া সোরেনসেন বলেন, ‘জলবায়ু-সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকির একটি মিশ্র সংকট আমরা দেখছি। এ গ্রহের উষ্ণতা বাড়ার ফলে আবহাওয়ার রীতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে, আরো ঘনঘন ঘটছে এবং আরো তীব্রতর হচ্ছে।’ তিনি বলেন, মানুষ এসবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু আরো উষ্ণ ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হতে পারে। কাজেই ভবিষ্যতে চরম তাপমাত্রা থেকে নিজেকে ও অন্যকে রক্ষার কৌশল জানা, স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন থাকা এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।