প্রতিবছর নবীন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় অনুরণিত হয় দেশের সেরা সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আর এর সঙ্গে তাদের মানসিক বিকাশে প্রধান বাধা হয়ে ওঠে র্যাগিং নামক অপসংস্কৃতি। র্যাগিং শব্দের প্রচলিত অর্থ পরিচয়পর্ব। নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরোনো শিক্ষার্থীদের সখ্য গড়ে তোলার জন্য যে আনুষ্ঠানিক পরিচিতি প্রথা সেটাকেই র্যাগিং বলা হলেও বাস্তবে আদব-কায়দা শেখানোর নামে তাদের ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে আছে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা, কান ধরে ওঠবস করানো, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা, টাইলস গণনা, নির্দিষ্ট স্থান থেকে মাটি আনতে বলা, পানিতে চুবানো, উঁচু ভবন থেকে লাফ দেওয়া, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেওয়া, গাছে ওঠানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানো, এমনকি রড দিয়ে মারা, আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি, জোরপূর্বক কাপড় খুলে নেওয়া! আর মানসিক নির্যাতনের মধ্যে আছে কুত্সা রটানো, গালিগালাজ করা, নজরদারি এবং নিয়মিত খবরদারি। যার ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেমন শারীরিক এবং মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি, বুলিং এবং হয়রানি, ব্যক্তিগত মর্যাদার লঙ্ঘন, আঘাত এবং মৃত্যুর ঝুঁকি। এর ফলাফল হিসেবে অনেক শিক্ষার্থী ভয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়।
বস্তুত, ক্যাম্পাসে আসা নবীনরা সর্বদাই র্যাগিংয়ের ভয়ে ভীত থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এটাকে আবার অনেক জ্ঞানী সম্মান ও শ্রদ্ধা বলে মনে করেন! আজ যে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে, সে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে এর চেয়ে বেশি মাত্রায় র্যাগিং করার পরিকল্পনা করবে। ফলে এ অপসংস্কৃতির বন্ধ হবে না।
সামপ্রতিক বছরগুলোর দিকে যদি লক্ষ করি তাহলে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পযর্ন্ত এই পাঁচ বছরে সবচাইতে বেশি র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে রয়েছে দেশ সেরা নামকরা প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি এক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পিছিয়ে নেই। স্যারকে তাড়িয়ে, বাবার সামনে মেয়েকে, ক্লাস রুমে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে র্যাগিং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে—যেটা সত্যিই পীড়াদায়ক।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্ত জ্ঞানচর্চার জায়গা। যেখানে শিক্ষার্থীরা ইচ্ছেমতো বিচরণ করবে এবং জ্ঞান সঞ্চয় করবে। তবে আমরা শুরুতেই কেন শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলছি? কেন তাদের স্বাভাবিক গতিপথকে রোধ করে দিচ্ছি? কেন তাদের ম্যানার শেখানোর নামে নিকৃষ্ট কাজের দিকে ধাবিত করছি? প্রকৃতপক্ষে এটা কখনোই কাম্য নয়। মূলত প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় র্যাগিং সংঘটিত হয়। এইসব প্রভাবশালী গোষ্ঠী, সংস্থা, সংগঠনকে চিহ্নিত করে এর পেছনে কারা ইন্ধন দিচ্ছে—চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে।
সর্বোপরি, আমাদেরকে এ অপসংস্কৃতির চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের। একটি নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মুক্ত চিন্তার জাদুঘর ও প্রতিভা বিকাশের পরিবেশ তৈরি করার জন্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে এবং এই ধরনের ক্ষতিকারক অভ্যাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলার জন্য বাস্তবায়ন করতে হবে কঠোর শাস্তির বিধান।