আসন্ন বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিচ্ছে বিরোধী দলগুলো। বিষয়টি নিয়ে এখনো পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে তারা। তবে এমন অচলাবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি কী হতে পারে বা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকাই বা কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ম্যাগাজিন দ্য ডিপ্লোম্যাট বিষয়টি নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ম্যাগাজিনটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সম্পাদক সুধা রামচন্দ্রন। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা জবাব দিয়েছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক অভিনাষ পালিওয়াল।
সাক্ষাৎকারে সুধা রামচন্দ্রন অভিনাষ পালিওয়ালের কাছে জানতে চান, ‘আওয়ামী লীগ এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের লক্ষ্য নিয়েছে যে, বিএনপি ও তার মিত্ররা যদি বিজয়ী হয় তাহলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থি শক্তির উত্থান ঘটবে। তাদের এই দাবি কতটা বিশ্বাসযোগ্য? ইসলামপন্থিরা বাংলাদেশে কতটা শক্তিশালী?’
উত্তরে অভিনাষ পালিওয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশে ইসলামপন্থিরা বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী আগের মতো তীব্র শক্তিশালী অবস্থায় নেই। তবে তারা এখন ‘রাজনৈতিকভাবে মৃতের’ কাছাকাছি থেকেও অনেক দূরে। কেননা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে সফলভাবে দমন করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালে জামায়াতের যেসব সহযোগীর সঙ্গে পাকিস্তানের যোগাযোগ ছিল তাদের বিচার করতে অভ্যন্তরীণভাবে আওয়ামী লীগ সরকার এই আদালত গঠন করে। এর সঙ্গে হেফাজতে ইসলামীর সহযোগিতার ফলে সরকার ইসলামপন্থিদের রাজনৈতিক শক্তিকে ভোঁতা করে দিয়েছে। ফলে বিএনপির বিজয়ে ইসলামপন্থিদের উত্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের দাবি অতিরঞ্জন ছাড়া কিছু নয়।’
‘বরং আওয়ামী লীগের এ দাবি থেকে মুক্ত হতে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ইসলামপন্থিদের সহিংসতার যে রূপ দেখা দিয়েছিল তা থেকে বেরিয়ে আসতে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে বিএনপি। জোট সরকারের ক্ষমতাকালে তখনকার বিরোধী দল ও বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর বোমা হামলা হয়েছিল। এতে তিনি মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছেন। তবে এসবকিছু থেকে বেরিয়ে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে রাজনৈতিক অবস্থান করতে চাচ্ছে বিএনপি। এ জন্য জামায়াতের সাথে দূরত্ব বজায় রাখছে দলটি। ফলে বিএনপি বিজয়ী হলে ইসলামপন্থিদের আন্তঃসীমান্ত সহিংসতা অথবা বাংলাদেশের ভিতরে হিন্দু ও বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত।’
চীনের সাথে বিএনপির উষ্ণ সম্পর্ক ছিল। আওয়ামী লীগের সময়ে বাংলাদেশে চীন তাদের পদচিহ্ন সম্প্রসারণ করেছে। বাংলাদেশে উদ্ভূত এই সংকটের সমাধান কী? এমন প্রশ্নের জবাবে অভিনাষ পালিওয়াল বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে চীন দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছে। অনেক বিবৃতি দিয়ে তারা তাদের এই অবস্থান পরিষ্কার করেছে। সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকসের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই সাক্ষাৎকারে এমনই বার্তা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, চীনের সাথে বিএনপির উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে বলা হলেও দলটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে চীনের তুলনায় দৃঢ় সমর্থন পাচ্ছে। বিএনপি পশ্চিমা দেশগুলোকে এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশকে পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা না গেলেও তাদের প্রভাব কমিয়ে আনা হবে। এর মানে হচ্ছে, আমরা এমন এক পরিস্থিতি দেখছি, যেখানে শেখ হাসিনাকে চীন এবং ভারত উভয়ই সমর্থন করছে। যদিও দেশ দুটি একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এখন চীনের প্রভাবে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে হারিয়ে ফেলাই হলো ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। নয়াদিল্লি এবং বিএনপির মধ্যে কথোপকথনের অভাব বাংলাদেশে ব্যাপক কৌশলগত সমতা নিয়ে ভারতকে পীড়া দেয়। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে সত্যিকার অর্থে সমাধান দেওয়া থেকে দূরে ছিল বিএনপি। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাস। যার কারণে তাদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের যে চেষ্টা তার তেমন কোনো ফল দেয়নি। আমি মনে করি ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন অনেকদূর এগিয়ে নিতে পারে। যদি ওয়াশিংটন ভারতকে আশ্বস্ত করতে পারে যে, তারা বিএনপিকে ভারতের কৌশলগত স্বার্থবিরোধী কোনো কিছু করা থেকে বিরত রাখবে, ইসলামপন্থিদের প্রভাব সীমিত করবে এবং চীনের স্বার্থকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাহলে হয়তো সম্মতির একটি সম্ভাবনা থাকতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন গ্যারান্টি ছাড়া ভারত বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া মানবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সততার বিনিময়ে হলেও সেই সম্ভাবনা নেই।’
অভিনাষের কাছে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশে আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় ভারত এবার অনেকটাই নীরব কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে সেভাবে ভারতীয় বিবৃতি আসছে না। বর্তমান অচলাবস্থার বিষয়ে ভারতের স্পষ্ট অবস্থানও দেখা যাচ্ছে না। তার অর্থ এই নয় যে, ভারত নীরবতা রক্ষা করে চলেছে। এমনটা যদি হয়েও থাকে তার মানে হচ্ছে, ভারতীয় কর্মকর্তারা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন, তারা একাধিক পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা এমন একটা ফল বের করে আনার চেষ্টা করছেন যাতে ভারতের স্বার্থ থাকে এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৃষ্টিতেও তার বৈধতা থাকে। উদাহরণস্বরূপ সম্প্রতি জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব নয়াদিল্লি সফর করেছেন। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগও বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলকথা হলো, অন্যদের তুলনায় ভারত শেখ হাসিনাকে পছন্দ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অনিয়মের ফলে যে কূটনৈতিক ক্ষতি, সেটি ভারত চিরতরে নিজের কাঁধে বহন করতে চায় কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন। তবে, সেই সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। বলা হয়, ভারত ও বাংলাদেশের ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, তারা সব সময় একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে।