শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। এই শপথের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের দীর্ঘ আধিপত্য শেষ হলো। শুক্রবার শ্রীলঙ্কার প্রধান বিচারপতি জয়ন্থা জয়সুরিয়া তাকে শপথ বাক্য পাঠ করান। এর আগে গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন পার্লামেন্টের স্পীকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে। শুক্রবার পার্লামেন্টে এ ঘোষণা দেন তিনি। এর পরপরই কলম্বোসহ দেশটির বিভিন্ন জায়গায় মিষ্টি বিতরণ করেন বিক্ষোভকারীরা।
স্পীকার বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে নয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হবে। ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ব্যাপক জনবিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালানো গোতাবায়া ই-মেইলে স্পীকারের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান। শুক্রবার সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন স্পীকার। স্পীকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে তার ঘোষণায় বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ৩৮.১ (বি) ধারা অনুযায়ী আমি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছি। ঘোষণা অনুযায়ী, ১৪ জুলাই ২০২২ থেকে এ পদত্যাগপত্র কার্যকর হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট তাঁর দায়-দায়িত্ব থেকে আইনত পদত্যাগ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেয়ার সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্টের কার্যক্রম ও দায়িত্বগুলো পালন করবেন। সে সময় প্রেসিডেন্টের কার্যালয় পরিচালনার ক্ষমতা তাঁর কাছে থাকবে। স্পীকার আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে আয়োজিত এক বৈঠকে দলীয় নেতারা বলেছেন, ১৯৮১ সালের স্পেশাল প্রভিশনস এ্যাক্ট-২ এবং সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হবে। সফলভাবে ও দ্রুততার সঙ্গে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ইচ্ছা আছে আমার। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন দলের নেতা, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন স্পীকার।
বৃহস্পতিবার রাত থকেই রাজধানী কলম্বোসহ দেশটির প্রায় সব শহরের সড়কে আনন্দমিছিল বের করেন তারা। বিক্ষোভকারীদের অন্যতম নেতা ভিরাগা পেরেরা বলেন, ‘গোতাবায়ার বিদায়ে আমরা যে কত খুশি, তা বলে বোঝানোর ভাষা নেই। এখন থেকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার যাত্রা শুরু হবে।’ খবর এএফপি ও বিবিসির।
দীর্ঘ আন্দোলনের পর পদত্যাগ করেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া লঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুর পৌঁছার পরপরই ই-মেইলে দেশটির স্পীকার বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন তিনি। এ ১৯৭৮ সালে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম দেশটির কোন প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলেন। স্পীকারের দফতর এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত সিঙ্গাপুর দূতাবাসের মাধ্যমে গোতাবায়ার পদত্যাগপত্র পেয়েছেন। তবে আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি ঘোষণা করা হবে। সঙ্কটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন দেশটির সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রথম ফিল্ড মার্শাল শরৎ ফনসেকা। তামিল টাইগারদের পরাজিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। এক সংবাদ সম্মেলনে ফনসেকা বলেন, পদুজানা পেরামুনা দলের একটি বড় অংশ এবং অন্য দলের পার্লামেন্ট সদস্যরা আমাকে প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার অনুরোধ করেছেন। আমি এ দায়িত্ব পালনে রাজি।
২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ফনসেকা।
শ্রীলঙ্কানদের ক্ষোভ এখন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের দিকে ঘুরে গেছে। দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে বুধবার রনিলের নাম ঘোষিত হয়। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগের পর স্পীকার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহের নাম ঘোষণা করেন। রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে গেলেও রনিল তা উপভোগ করার যথেষ্ট সময় পাবেন না বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ বিক্ষোভকারীরা রনিলকে রাজাপাকসে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে বিবেচনা করে। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে জাতিসংঘ। জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী জানায়, সরকারী সম্পত্তি, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ঝুঁকিপূর্ণ স্থান এবং মানুষের জীবন রক্ষা করার জন্য শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা পেয়েছেন সেনাসদস্যরা। সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে পার্লামেন্টে সংঘর্ষের সময় বিক্ষোভকারীদের একটি অংশের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার নিন্দা জানায়। ওই সংঘর্ষের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে দুটি এ্যাসল্ট রাইফেল কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, সংঘর্ষের সময় সেনাবাহিনীর কয়েক সদস্য আহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, পার্লামেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছে সংঘর্ষে একজন নিহত এবং ৮৪ জন আহত হয়েছেন।
বুধবার শ্রীলঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে তিন বাহিনীর কয়েক কমান্ডার ও প্রতিরক্ষা সচিবের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যা যা করণীয়, সবকিছু করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ভবন ছেড়ে যেতে বিক্ষোভকারীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি তাদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানান। নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কট ও গণআন্দোলনের মুখে গত মঙ্গলবার রাতে সামরিক বিমানে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পালিয়ে যান শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। বৃহস্পতিবার তিনি সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর পৌঁছান। এরপর তিনি সৌদি আরব অথবা সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারেন। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, গোতাবায়া দেশটিতে তার ব্যক্তিগত সফরে রয়েছেন। কোন ধরনের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেননি। এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, সিঙ্গাপুর হয়ে সৌদি আরবের জেদ্দায় যাবেন গোতাবায়া। তবে এ খবরকে অস্বীকার করেছে সৌদি আরব।
শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে দেশত্যাগ না করার বিষয়ে আদালতে মুচলেকা দিয়েছেন। মাহিন্দা ও বাসিল তাদের আইনজীবীদের মাধ্যমে দেশটির সুপ্রীমকোর্টে মুচলেকা দেন। তারা অঙ্গীকার করেন, তাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া আবেদনের শুনানি না হওয়া পর্যন্ত তারা দেশ ছাড়বেন না। গোতাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা। তিনি মে মাস পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। গণবিক্ষোভের মুখে তিনিও পদত্যাগ করেন। গোতাবায়ার ছোট ভাই বাসিল। তিনি দেশটির অর্থমন্ত্রী ছিলেন। নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কট ও গণআন্দোলনের মুখে মঙ্গলবার রাতে একটি সামরিক বিমানে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পালিয়ে যান গোতাবায়া। এই যাত্রায় তার সঙ্গী হন স্ত্রী ও দুই নিরাপত্তারক্ষী। শ্রীলঙ্কাজুড়ে চলমান সহিসংতা পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস। এক টুইটবার্তায় তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে সংঘর্ষের মূল কারণ এবং আন্দোলনকারীদের অভিযোগ সমাধান করা। সঙ্কট উত্তরণে দেশটির সব দলের নেতাদের শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে সমঝোতার মনোভাব গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। এর আগে দুই দফা পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ৭৩ বছর বয়সী গোতাবায়া।
নিত্যপণ্য, জ্বালানি ও শিশু খাদ্যর মারাত্মক সঙ্কটের কারণে শ্রীলঙ্কায় কয়েক মাস ধরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চলছে। শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনতা মনে করছে এসব পরিস্থিতির জন্য রাজাপাকসে পরিবারের দুর্নীতি ও ভুল সিদ্ধান্ত দায়ী। গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশত্যাগ করার পর প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। বুধবার পার্লামেন্টের স্পীকার এই ঘোষণা দেন। এরপর চলমান বিক্ষোভ আরও তুঙ্গে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা একপর্যায়ে কলম্বোর প্রধানমন্ত্রী দফতরের প্রধান ফটকের তালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। পরিস্থিতি আঁচ করে আগেই দফতর ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী।