সরকারের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়। মুখে বলা হলেও বাস্তবে নির্বাচন কমিশনের কোনো ক্ষমতা নেই বলে জানিয়েছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেছেন, নির্বাচনের জন্য দেশে অনুকূল পরিবেশ নেই। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রশাসন একটি দলের হয়ে ভোট চাচ্ছে। গত দুইটি নির্বাচনের মতো আসন্ন নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল থেকে বলা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না। আর সরকার বলছে, সংসদ বহাল রেখে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। এটা রাজনীতিবিদদের সমাধান করতে হবে।
গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন :প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনা ও পর্যালোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে বলেন, জামালপুরের মতো ডিসিদের বিরুদ্ধে আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জামালপুরের ডিসি বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে। এই খবর সব পেপারে দেখলাম। এই ডিসিদের দিয়েই আপনাদের নির্বাচন করতে হবে। এদের দিয়ে ক্রেডিবল (বিশ্বাসযোগ্য) নির্বাচন হবে না। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, এক জেলায় চার জন রিটার্নিং কর্মকর্তা দিয়ে নির্বাচন করাতে পারেন। তিনি বলেন, আপনাদের কাজটি অত্যন্ত কঠিন। আপনাদের হাত-পা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আপনারা একা সিদ্ধান্ত নেবেন। একটা বড় দল যদি নির্বাচনে না আসে, আরও ৩০০ দল যদি আসে তবু নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে পারবেন না। প্রতি ঘণ্টায় কত ভোট পড়েছে, তার হিসাব রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, ঢাকা-১৭ আসনে একজন প্রার্থীকে আমরা মারতে দেখলাম। পলিটিক্যাল পার্টি সেন্টার পাহারা দেয়। এদের শনাক্ত করে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া অযোগ্য এনজিওদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
যদি ব্যর্থ হই, তাহলে মাশুল দিতে হবে :সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রগুলো আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করছে। আমরাই এদের ডেকে এনেছি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র আমাদের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের এর মাশুল দিতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের হাতে ক্ষমতা থাকার পরও গাইবান্ধা নির্বাচনে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সেখানে পক্ষপাতের অভিযোগ করা হলে তা ভুল হবে না। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
বাস্তবতা আপনাদের অনুকূলে নেই :সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, বাস্তবতা আপনাদের অনুকূলে নেই। ডিসি ও এসপিরা একটি পক্ষের হয়ে ভোট চাচ্ছে। আমরা এখানে ভালো নির্বাচনের জন্য বক্তৃতা দেব আর ডিসি একটি পক্ষের হয়ে ভোট চাইবে, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা কি দেখব। এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার না চাইলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব না। যতগুলো ভালো নির্বাচনের উদাহরণ আছে, সেগুলো সরকার চেয়েছে বলেই হয়েছে। তখনো কিন্তু এই ডিসি, এসপিদের দিয়েই নির্বাচন হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত গাইবান্ধার নির্বাচনে অভিযুক্ত একজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নির্বাচনের পরে কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রপতি পদক, প্রধানমন্ত্রী পদক ইত্যাদি পদক গণহারে দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে ব্যাপক আলোচনার দরকার। আপনারা নির্বাচন কমিশনে ডিসিদের সঙ্গে মিটিং করেছিলেন। সেখানে কয়েক জন ডিসির আচরণ ঠিক ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে আপনারা ব্যবস্থা নেননি।
মুখে ক্ষমতাবান বললেও বাস্তবে কিছুই নেই :মুখে বললেও বাস্তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কোনো ক্ষমতা নেই বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা মুখে শুধু বলি নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাবান, কিন্তু বাস্তবে কিছুই নেই। সংকটটা এত কঠিন সব দায় কমিশনের ওপর দিয়েও লাভ নেই। একের পর এক এমন চলতে থাকলে মান-মর্যাদা থাকবে না। তিনি বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে। এই পরিবেশ থেকে উত্তরণে আদালতও ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ কোর্টের রায়ের ফলে এই সংকট তৈরি হয়েছে। ইসির উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা সবার থেকে পরামর্শ শুনছেন কিন্তু পরামর্শ বাস্তবায়ন করতে পারেননি। না পারার কারণ আপনাদের ব্যাখ্যা করা দরকার।
নির্বাচনের ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে :জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, নির্বাচনের ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতি অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা হয়। তাদের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনারা বলেছেন সকাল ৮টার মধ্যে ব্যালট বাক্স পাঠিয়ে দেবেন। এটা চ্যালেঞ্জিং। এটি যাতে ঠিকভাবে করা যায়, সেই ব্যবস্থা আপনারা নেবেন। ঠিক ৮টার সময়ই যাতে ভোট কার্যক্রম শুরু করা যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
এখনো ভীতিকর পরিস্থিতি বিদ্যমান :সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ূন কবীর বলেন, এখন ভীতিকর পরিস্থিতি বিদ্যমান। আগামীতে কি হতে যাচ্ছে তা নিয়ে সবার মধ্যে একটি আশঙ্কা কাজ করছে। তিনি বলেন, মানুষ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনও রয়েছে। আরপিওতে নির্বাচন কমিশন কেন ক্ষমতা কমাল সেটি নিয়েও মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। যেখানে আপনারা নিজেদের ক্ষমতা বাড়াবেন, সেখানে আপনারা ক্ষমতা কমিয়েছেন বলে জনগণের ধারণা। মানুষ হতাশ হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা বিশ্বাসহীনতায় রয়েছে : বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থা বিশ্বাসহীনতায় রয়েছে। একটা ভালো নির্বাচন হলেই যে সব সমস্যা সমাধান হবে, তা নয়। তবে ভালো নির্বাচন সমাধানের সূচনা হতে পারে।
এমন কোনো নির্বাচন চাই না, যা একতরফা হোক : আমরা যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। নির্বাচন জনগণের জন্য। নির্বাচন কমিশন ভোটার ও ভোটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন কীভাবে। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট কাছাকাছি। ৩৩ বা ৩৭ শতাংশ ভোটারকে বাইরে রেখে নির্বাচন করলে সুষ্ঠু হবে না। প্রধান চ্যালেঞ্জ সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করা। গণতন্ত্র কাজ না করলে নির্বাচন অর্থহীন। আপনারা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে বৈঠকে বসানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে সব দলের প্রচার যেতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসান হাবিব খানের সঞ্চালনায় ওয়ার্কশপে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান, ইসি সচিব ও আমন্ত্রিত অন্য সুধীজনরা উপস্থিত ছিলেন। আট জন আলোচকের বাইরে ২০ জন আমন্ত্রিত অতিথিকে অনুষ্ঠানে ইসির পক্ষ থেকে দাওয়াত দেওয়া হয়।