সবাই ভাগ্য বদলাতে চান, ক’জনই বা পারেন। আবুল খায়ের হিরো- সরকারের ছাপোষা এক কর্মকর্তা হয়ে মাত্র দুই বছরে যেভাবে নিজের জীবনের বাঁক বদলেছেন, তা কেবল চলচ্চিত্রেই সম্ভব। সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরো শুধু নামে নন, শেয়ারবাজারের অঘোষিত ‘হিরো’ বনেছেন। শেয়ার কারসাজি করে একদিকে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, গড়েছেন সমাজের প্রভাবশালীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক। দু’বছর আগেও যাকে কেউ চিনত না, সেই তিনি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো এমন জাদু দেখিয়েছেন, যার বদৌলতে লাখ লাখ মানুষ তো বটেই, দু-চারজন সেলিব্রেটিও ছুটছেন তাঁর পিছু পিছু। সেই দলে আছেন সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা, সম্পদশালী ব্যক্তি, ব্যাংকের মালিক, সাংবাদিকসহ নানা পেশার মানুষ।
তাঁর হাতে আছে রাতারাতি ধনকুবের হওয়ার অত্যাশ্চর্য জাদুর কাঠি। সেই কাঠির ছোঁয়ায় আগাগোড়া বদলেছেন হিরো। হিরোর ছায়ায় থেকে পাল্টেছে অনেকেরই জীবনের রং। তেমনই একজন তাঁর শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। শেয়ার ব্যবসায় নেমে এক বছরের মধ্যেই রাজধানীর বনানীতে কিনেছেন প্রায় তিন কোটি টাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, তাঁর দাবি, সম্প্রতি তা হিরোর কাছে বিক্রি করেছেন। শোনা যায়, আরেক ব্যবসায়ী ও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মালিক হিরোর ওপর ভর করে এত টাকা কামিয়েছেন যে, আনন্দে উদ্বেল হয়ে হিরোকে আড়াই কোটি টাকা দামের রেঞ্জ রোভার গাড়ি উপহার দিয়েছেন।
সরকার থেকে হিরো বছরে বেতন-ভাতা পান সাকল্যে সাত থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা। তবে গত বছরের জুনের শেষে তিনি যে আয়কর নথি জমা দিয়েছেন, তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন- ওই অর্থবছর শেষে তাঁর নিট সম্পদমূল্য ২০ কোটি ২১ লাখ টাকা ছিল, যা আগের বছর ছিল ৬৫ লাখ টাকারও কম। অর্থাৎ এক বছর ব্যবধানে তাঁর বেড়েছে সাড়ে ১৯ কোটি টাকার সম্পদ। আবার ঋণসহ মোট সম্পদমূল্য দাঁড়ায় ৮৭ কোটি টাকা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এটা শুধু তাঁর একার এবং এখন থেকে এক বছর আগের তথ্য এটা।
হিরোর পরিবারের সদস্যদের টাকা কামানোর গল্পটা আরও পিলে চমকানো। ৩১তম বিসিএস (সমবায়) ক্যাডারভুক্ত সরকারি এই কর্মকর্তার স্ত্রী কাজী সাহিদা হাসান (তখন গৃহিণী) ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে শেয়ারবাজার থেকে আয় করেছেন ৫০ কোটি টাকার বেশি। তাঁর বৃদ্ধ বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মাতবরের ওই সময়ের আয় ২০ কোটি টাকারও বেশি। আর ছোট বোন কনিকা আফরোজ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তাঁরও ওই বছরে আয় পৌনে ১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে পুরো পরিবারের আয় প্রায় ১০৬ কোটি টাকা।
এই আয়ের সবটা মিলে তাঁদের পরিবারের মোট সম্পদমূল্য এক বছর আগেই ২৭৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ছাড়ায়, যা ২০১৯ সালের শেষেও ছিল মাত্র দুই কোটি টাকা। এই আয় ও সম্পদের কোনো কিছুই তাঁর বাবা, স্ত্রী বা বোনের অর্জন নয়। আয়কর নথিতে উল্লেখ করা বাবার ৬১ লাখ টাকার সম্পদের বাইরে বাকি সবটাই হিরোর শেয়ার কারসাজির অর্জন।
এখানেই শেষ নয়, শেয়ার কারসাজির আয়ের টাকায় এখন বেশ কিছু কোম্পানির মালিকানায় তিনি। খুলেছেন মোনার্ক নামে নতুন ই-কমার্স সাইটের ব্যবসা। গড়ছেন মোনার্ক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট। তাঁর টাকার ঝনঝনানি এতই বেশি যে, ক্রিকেটে বিপিএলের অন্যতম প্রধান ফ্র্যাঞ্চাইজি বরিশাল ফরচুনের মালিক বনেছেন। গেল মৌসুমে নিজে উপস্থিত থেকে নিলামে ক্রিস গেইলসহ বিশ্বসেরা ক্রিকেটারদের দলে ভিড়িয়েছেন। বরিশাল ফরচুনের প্রতিটি ম্যাচে হিরো নিজে মাঠে উপস্থিত ছিলেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে কী করে বিপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক হলেন- প্রকাশ্যে এ নিয়ে মাতামাতি করার পরও কেন তাঁর সরকারি দপ্তর থেকে কেউ প্রশ্ন তোলেনি, তা এক বড় প্রশ্ন।
এদিকে হিরোর কারসাজি প্রমাণ করার সবকিছুই শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে আছে। কোন ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে, কবে, কখন, কীভাবে এবং কার সঙ্গে মিলে কোন শেয়ার নিয়ে কারসাজি করেছেন- সব জানে এ সংস্থা। তার পরও ব্যবস্থা না নেওয়ায় মনে হয়, বিএসইসির আশ্রয়-প্রশ্রয়েই হিরো শেয়ারবাজারে হিরোগিরি করছেন।
হিরোর কারসাজির তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে ব্যাপক বাধার পরও তাঁর শেয়ার কেনাবেচা, আয়কর নথি এবং ব্যাংক হিসাবের অনেকটাই সংগ্রহ করেছে সমকাল। সমকাল অনুসন্ধান করে দেখেছে, হিরো গত দুই বছরে মূল শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৫০ কোম্পানির মধ্যে ৬৮টির শেয়ার কেনাবেচা করেছেন। ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স দিয়ে কারসাজি শুরুর পর গত দুই বছরে আরও তিন ডজন শেয়ার নিয়ে বড় ধরনের কারসাজির করেছেন। শেয়ার লেনদেন করতে গিয়ে সব আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করেছেন। নিজের স্ত্রী, বাবা, বোন ও নামসর্বস্ব সমবায় সমিতির নামে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে শেয়ার কেনাবেচা করেন। সার্কুলার বা সিরিজ ট্রেড করে শেয়ারের দাম বাড়িয়েছেন, যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অধ্যাদেশ ১৯৬৯-এর ১৭(ই) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়ে ওই শেয়ার কিনেছেন, তখন হিরো তাঁর সব শেয়ার বিক্রি করে নিজের মুনাফা নিয়ে তুলে নিয়েছেন।
আইনের লঙ্ঘন করে হিরো শেয়ার ব্যবসা করছেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জানার পরও শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সার্ভেল্যান্স বিভাগ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) হিরো ও তাঁর সিন্ডিকেটের বিষয়ে গত দুই বছরে অন্তত ২০টি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন এবং নিয়মিত সার্ভেল্যান্স প্রতিবেদনে শতাধিকবার তথ্য দিয়েছে। এসব প্রতিবেদন দেখেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিএসইসি। উল্টো এক তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানোর পর এক চিঠিতেই ডিএসইর সংশ্নিষ্ট বিভাগের তৎকালীন ইনচার্জসহ সবাইকে একযোগে বদলি করার আদেশ দিয়েছে বিএসইসি, যা এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে।
যদিও বিএসইসি আইনের ৮ ধারায় কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব হলো প্রতারণামূলক ও অসাধু শেয়ার ব্যবসা বন্ধ করা। কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে ১৯৬৯ সালের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশের ১৭(ই) ধারায় স্পষ্ট করে যা বলা আছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে হিরোর বিরুদ্ধে শুধু কারসাজি নিয়ে প্রশ্ন তোলাই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারে। অপরাধ প্রমাণ হলে তাঁর সব মুনাফা তো বটেই, এ পথে উপার্জিত সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত, জেল ও জরিমানা সবই হতে পারে।
জানা গেছে, হিরোর অন্যতম ব্যবসায়িক পার্টনার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। বিপিএলে হিরোর বরিশাল ফরচুনের অধিনায়কও ছিলেন তিনি। সাকিবের সঙ্গে স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজ হাউস মোনার্ক হোল্ডিংস এবং ই-কমার্স সাইট মোনার্ক মার্টের অংশীদার হিরোর স্ত্রী সাদিয়া। কাগজে-কলমে মালিকানায় স্ত্রী হলেও বাস্তবে হিরো একাই সব সামলান। সাকিবও ব্যবসায় অর্থ লগ্নি করা ছাড়া আর কিছুই করেন না- এটা হিরোরই ভাষ্য। এ বিষয়ে সাকিব আল হাসানের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
হিরো সাধারণ সরকারি কর্মকর্তা হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক লাউঞ্জ লাখ লাখ টাকা খরচ করে আধুনিকায়ন করেছেন। শিক্ষক লাউঞ্জের সামনের ফটকে নিজের সরকারি পরিচয়সহ নামফলক জ্বলজ্বল করছে। এ ঘটনায় মার্কেটিং বিভাগ তাঁকে সংবর্ধনাও দিয়েছে, যে খবর গণমাধ্যমে ছাপাও হয়েছে।
নিজে সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা হয়ে একের পর এক সমবায় সমিতি খুলেছেন, বিনিয়োগ করেছেন, আবার কোটি কোটি টাকা ধারও করেছেন। সমবায়গুলো হলো- ডিআইটি কো-অপারেটিভ, দক্ষিণাঞ্চল কো-অপারেটিভ সোসাইটি, নিসর্গ সমবায় সমিতি, পি ৫৯ এফটিসি কো-অপারেটিভ ও বেঙ্গল এগ্রো সমবায় সমিতি। নিজে ও স্ত্রীর সঙ্গে অন্যদের ট্যাক্স ফাইলে এসব সমবায় সমিতিতে কোটি কোটি টাকার শেয়ার থাকা, ঋণ দেওয়া ও দেওয়ার তথ্য নিজেরাই উল্লেখ করেছেন।
প্রশ্ন হলো, হিরো একা কীভাবে এত অর্থ এবং প্রভাবশালীদের সান্নিধ্য ও সমীহ পেলেন। এ প্রশ্নের উত্তর আছে তাঁর ও পরিবার সদস্যদের আয়কর নথি এবং ব্যাংক হিসাবে। সেখানে দেখা গেছে, হিরো ও তাঁর পরিবার সদস্যদের শতভাগ আয় এসেছে শেয়ার কারসাজি করে। হিরো গত দুই বছরে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের কারসাজি চক্রের সবচেয়ে বড় হোতা (গ্যাম্বলার) বনেছেন।
সম্প্রতি শেয়ারবাজারের এক বিনিয়োগকারী ফেসবুকের একটি গ্রুপে লিখেছেন, “আগে কোনো শেয়ারের দাম বাড়লে বলা হতো গ্যাম্বলার ঢুকেছে, এখন বলা হয়, ‘হিরো’ ঢুকেছে।” এক বছর আগে এ প্রতিবেদকের কাছে হিরোই বলেন, ‘আমি ওমুক শেয়ার কিনছি বা আছি এমনটা প্রচার করে কেউ কেউ নানা শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে, অথচ ওই শেয়ারের ধারে-কাছেও আমি নাই।’
গত দুই বছরে শেয়ারবাজারে যত কারসাজি হয়েছে, এর সবটাই হিরো করেননি। হিরোর আগে এ বাজারে যেসব জুয়াড়ি চক্র ছিল, তারা এখনও আছে। তাদের সম্মিলিত কারসাজি হিরোর কাছে ‘শিশু’ বনেছে। অন্য জুয়াড়িরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে দুর্নীতি ও অপরাধ শনাক্তকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়-প্রশ্রয় সাধারণত পায় না, যা হিরো পেয়েছেন। এখানেই হিরো অনন্য।
অথচ শেয়ার কারসাজি তো দূরের কথা, শেয়ার ব্যবসা করার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর বিধিনিষেধ আছে। পাবলিক সার্ভেন্টস (কন্ডাক্ট) রুলসের ১৫ ধারায় সুস্পষ্ট বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা যে কোনো ধরনের স্পেকুলেটিভ বা অনুমানভিত্তিক কোনো ব্যবসায় (যেখানে দর খুব দ্রুত ওঠানামা করার সুযোগ আছে, যেমন- শেয়ার ব্যবসা) তাতে অভ্যাসগতভাবে জড়িত হতে পারবেন না। এমনকি তাঁর পরিবার সদস্যদেরও এ কাজে জড়িত হতে দেবেন না, যদি সরকারি কাজে প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ থাকে। অথচ নিজের শেয়ার কারসাজির সুবিধার জন্য হিরো নিজে একের পর এক সমবায় সমিতিকে শেয়ার কারসাজির সঙ্গে যুক্ত করছেন। নামসর্বস্ব সমবায় সমিতি খুলে এর মাধ্যমে কারসাজি করেছেন। তাঁর কারসাজির অংশীদার করছেন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং নানা পেশার মানুষকে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, পাবলিক সার্ভেন্টস (কন্ডাক্ট) রুলস ১৯৭৯ সব সরকারি কর্মকর্তার জন্য প্রযোজ্য। যদি এ বিধির কোনো ধারা কোনো সরকারি কর্মকর্তা লঙ্ঘন করেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সমবায় অধিদপ্তর হিরোর সব অবৈধ কর্মকাণ্ডের কথা জানে। এ বিষয়ে প্রশ্ন না তোলার কারণ, যাঁরা প্রশ্ন তুলবেন, তাঁদের অনেকেই হিরোর কারসাজির অংশীদার। যেমন- খোদ সমবায় অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক ড. মো. হারুন-অর-রশিদ বিশ্বাস। তিনি নিজেই হিরোর সঙ্গে শেয়ার ব্যবসায় জড়িত। হিরো যখন যে শেয়ার কিনছেন, তাঁর বিও অ্যাকাউন্টেও সে শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে। ড. হারুন ছাড়াও হিরোর এ তালিকায় বেশ কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক শীর্ষ আমলা আছেন। সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে হিরো জানান, বর্তমানে অন্তত ২৫ জন সচিব শেয়ার ব্যবসা করছেন।
সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মশিউর রহমানের কাছে হিরো এবং সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের শেয়ার ব্যবসা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নাই। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাও কিছু জানায়নি। লিখিত অভিযোগ বা পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার আগে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। হিরোর কারসাজির পর অনেক শেয়ারের দর চার ভাগের এক ভাগে নেমেছে। গত ১ জুলাই ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কাওসার আহমেদ নামে এক সাবেক সেনাসদস্য শেয়ারবাজারে টাকা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে একাই অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। তাঁর অভিযোগ, পেনশন আর ধার করা টাকা মিলে মোট ৬৫ লাখ টাকা শেয়ারে বিনিয়োগ করে খুইয়েছেন। প্রেস ক্লাবের সামনেই অবস্থান কর্মসূচি পালনের একপর্যায়ে জ্ঞান হারালে শাহবাগ থানার প্যাট্রল ইন্সপেক্টর তাঁকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যান।
এভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করার পরও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, জানতে চাইলে ডিএসইর কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান আইন স্টক এক্সচেঞ্জকে কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতাই নেই। প্রতিষ্ঠানটি শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে তার পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারে, তাঁরা তাই করেছেন। যেখানে কারও বিরুদ্ধে একটি বা দুটি প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিশন নিজে থেকে তদন্ত করার কথা, সেখানে অন্তত ২০টি তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরও তা এড়িয়ে যাওয়ায় প্রমাণ করে- নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিই চায় হিরো কারসাজি করুক।
স্টক এক্সচেঞ্জের একাধিক কর্মকর্তা আরও জানান, হিরোর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই হয়তো তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি বিএসইসির। কীসের কৃতজ্ঞতা- এমন প্রশ্নে তাঁরা বলেন, ২০২০ সালের আগের যে দরপতন কোনো কিছু করেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না, তখন এই হিরোদের কারসাজিতেই বাজার ঘুরে দাঁড়ায়। যদিও অনেকে মনে করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নতুন নেতৃত্বের কারণে বাজার ঘুরেছে। তবে আসল সত্য, কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানেন। শুধু এটাই কারণ নয়, নেপথ্যে আরও বড় কোনো ঘটনা রয়েছে- এমন বিশ্বাস করেন শেয়ারবাজারের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞদের।
হতে পারে, নেপথ্যের অন্য কিছুর কারণে হিরোর কারসাজির সবটা জেনেও তাঁকে দায়মুক্তি দিচ্ছে কমিশন। হিরোর কারসাজি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর চাপে পড়ে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার চাপ তৈরি হয় খোদ কমিশনের ভেতর থেকে। এ অবস্থায় গত জুনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বীমা খাতের তিন কোম্পানি এশিয়া, ঢাকা ও গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে হিরো সিন্ডিকেটের কারসাজির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় বিএসইসি। এর প্রতিটিতেই হিরোর সম্পৃক্ততা সুস্পষ্ট। হিরো এ ক্ষেত্রে কেবল তদন্তকালীন দেড় মাস সময়ে এই তিন কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করে রিয়েলাইজড (বিক্রি করে মুনাফা নেওয়া) সাড়ে ৯ কোটি টাকার মুনাফাসহ মোট সোয়া ১৬ কোটি টাকা মুনাফা করেন। অথচ তাঁকে বাদ দিয়ে কমিশন শুধু তাঁর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান ও তাঁর নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভকে নামমাত্র ২ কোটি ৭ লাখ টাকা জরিমানা করে।
বিএসইসির কর্মকর্তারা যা বলছেন :এ বিষয়ে জানতে বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে গত কয়েক মাসে বেসরকারি একাধিক টেলিভিশনে বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামকে বলতে শোনা যায়, তাঁর (হিরো) বিষয়ে অনেকে অভিযোগ করছেন। তবে কমিশন আইন লঙ্ঘনের কোনো প্রমাণ পায়নি। বরং এরা বাজারে গতি আনছে, মার্কেট মেকারের ভূমিকা রাখছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির এক কর্মকর্তা জানান, এতদিন চুপ থাকলে নানা চাপে পড়ে তাঁর স্ত্রীসহ অন্যদের শাস্তি দিয়ে দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ফলে আশকারা পেয়ে এখনও হিরো শেয়ার কারসাজি করছেন। সম্প্রতি চালু হওয়া এসএমই মার্কেটের তাঁর শেয়ার কারসাজিতেই রুগ্ণ কোম্পানিগুলোর দর হু হু করে বাড়ছে। যেখানে মূল শেয়ারবাজারের শেয়ারদরে লাগাতার পতন হচ্ছে। এত কিছুর পরও গত মে মাসেই কমিশন এখন অধুনালুপ্ত ওটিসিভুক্ত বন্ধ ও রুগ্ণ কোম্পানি আল-আমিন কেমিক্যাল এবং পারফিউম কেমিক্যাল কোম্পানির মালিকদের শেয়ার হিরো ও তাঁর স্বার্থসংশ্নিষ্টদের মাঝে হস্তান্তরের অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে হিরো নিজের এবং পার্টনার সাকিব আল হাসানের নামে এ দুই কোম্পানির শেয়ার কিনে নিয়েছেন। কোম্পানিকে দুটিকে শিগগিরই এসএমই বাজারে তালিকাভুক্তির তোড়জোড় চলছে।
সমবায় অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক ডিজির বক্তব্য: হিরোর শেয়ার কারসাজি এবং তাঁর ব্যবসা করা বিষয়ে জানতে চাইলে সমবায়ে সদ্য সাবেক ডিজি হারুন-অর-রশিদ সমকালকে বলেন, ‘এ বিষয় জানা নেই, কেউ জানায়ওনি।’ দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমে তাঁর কারসাজির রিপোর্টও কি নজরে পড়েনি- এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলেন তিনি। সাবেক এ ডিজি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কারও শেয়ার কেনাবেচায় নিষেধ নেই। অনেকেই এটা করেন। তবে তিনি কারসাজি করছেন কিনা, বিএসইসি তাঁকে জানায়নি।’ আপনি যে শেয়ার ব্যবসা করেন এবং হিরোর শেয়ার কেনাবেচার সঙ্গে পুরোপুরি যে মিল আছে, তার প্রমাণ সমকালের কাছে আছে- এ বিষয়ে মন্তব্য কী? এর উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ, এটা হতেই পারে। সরকারি কর্মকর্তার শেয়ার কেনাবেচায় নিষেধ নেই।’ হিরো সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সমবায় সমিতির মালিক ও ঋণ নিতে পারেন কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটাও আমার জানা নেই।’ এমন অনেক কিছু না জানলেও গত মে মাসেই তিনি ডিএসইতে চিঠি দিয়ে ব্যাংক-বীমার মতো সমবায় সমিতিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে অনুরোধ করেন।
ড. মিজানুর রহমানের বক্তব্য: হিরোর সঙ্গে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের মিলেমিশে শেয়ার কেনাবেচার অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে ড. মিজান বলেন, ‘হিরোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছাত্র-শিক্ষকের। তাঁর জানা মতে, সরকারি কর্মকর্তাদের শেয়ার কেনাবেচায় বাধা নেই।’ শুধু ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হলে হিরোর সঙ্গে তাঁর ব্যাংক হিসাবে অর্থ লেনদেন কী করে হলো- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বনানীতে কেনা ফ্ল্যাটটি হিরোর কাছে বিক্রি করেছেন।’ তিন কোটি টাকায় বনানীর ফ্ল্যাট কিনেছিলেন কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি এ তথ্যের উৎস জানতে চান এবং পরে নিজেই বলেন, ‘ট্যাক্স ফাইলে এ অঙ্ক উল্লেখ নেই।’ যেহেতু জমি ও ফ্ল্যাট প্রকৃত মূল্যে রেজিস্ট্রেশন হয় না, তাই ট্যাক্স ফাইলে ওই মূল্য লেখা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক কিনা- এমন প্রশ্নে ড. মিজান বলেন, ‘এটা সরকারকে বলেন।’
একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে হিরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম ও টিচারস লাউঞ্জ আধুনিকায়ন করলেন কী করে- এমন প্রশ্নে ড. মিজান বলেন, ‘যার সামর্থ্য আছে, তিনি অনুদান দিতে পারেন। সরকারি কর্মকর্তা নয়, ছাত্র হিসেবেই অনুদান নেওয়া হয়েছে।’
হিরো যা বললেন: সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল খায়ের হিরো বলেন, ‘আমি শেয়ার ব্যবসা করি। কারসাজির সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই।’ তবে গ্রিন ডেল্টার শেয়ার কারসাজিতে তাঁর স্ত্রী কাজী সাদিয়াকে ৪২ লাখ টাকা জরিমানার আদেশের কপি পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন। শেয়ার কারসাজির ঘটনায় তিনি কমিশনের আনুকূল্য পাচ্ছেন কিনা- জানতে চাইলে হিরো বলেন, ‘এটা বলতে পারব না।’ এ বিষয়ে আরও প্রশ্ন করতে চাইলে ‘শুনতে পাচ্ছি না, পরে ফোন করব’ বলে ফোন কেটে দেন।