♦ রিজার্ভে টান, খোলাবাজারে শতক ছাড়াল
♦ সংকট মোকাবেলায় নতুন চার সিদ্ধান্ত
♦ আজ থেকে ১০০ কোটি ডলারের সরবরাহ বাড়ছে
দেশে ডলারের চাহিদা বেড়েই চলেছে। কিন্তু সরবরাহ না বাড়ায় ক্রমেই সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের মধ্যেও দেশের বাজারে চড়া মূল্যেও ডলার মিলছে না। ঈদের আগ থেকেই বেশি দাম দিয়েও ডলার পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।ঈদের ছুটিতে বিদেশ ভ্রমণ বেড়ে যাওয়ায় খোলাবাজারেও ডলারের সরবরাহ কমে গেছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) আবার ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে ডলারের দাম।
ডলারের বাড়তি দামের কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ছে মূল্যস্ফীতিও। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ডলার সাশ্রয়ের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
ডলারের বিপরীতে টাকার মান দফায় দফায় কমানোর পরও স্বাভাবিক হচ্ছে না বাজার। রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়েও অস্থিরতা কাটছে না।
আমদানির তুলনায় রপ্তানি বাড়ছে না, কমছে রেমিট্যান্স
গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মে মাসের মধ্যে আমদানি ব্যয় ৩৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৫.৪০ বিলিয়ন ডলার। সেই তুলনায় রপ্তানি আয় ৩৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪৪.৫৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সোয়া কোটির মতো প্রবাসী দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে ১৫.১২ শতাংশ কম।
রিজার্ভের পরিমাণ কমে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় দায় রেমিট্যান্সের। মূলত বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আসার প্রধান দুটি দেশ সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া। গত অর্থবছরে এ দুটি দেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এতে চাপ পড়েছে রিজার্ভে।টাকার মান আরেক দফা অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় আরো বাড়বে, আর লাভবান হবেন রপ্তানিকারকরা। সাধারণত রপ্তানিকারকদের সুবিধা দিতেই স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হয়।
কেন বাড়ছে ডলারের দাম
যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বাড়ানোর পর শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রাবিনিময়ে ডলারের দাম বেড়ে দুই দশকে সর্বোচ্চ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেজারি ইল্ড (যে সুদের হারে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিভিন্ন মেয়াদে অর্থ ঋণ করে) বাড়ার পাশাপাশি চীনের লকডাউনে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরোর দাম ডলারের সমান হয়ে গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বাড়ার যে গতি তা অন্যদের চেয়ে বেশি। যেমন—ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়েও দ্রুতগতিতে সুদের হার বাড়াচ্ছে ফেড। সুদের হার বাড়ায় ডলার ঊর্ধ্বমুখী থাকবে।দি ইউএস ডলার ইনডেক্স অনুযায়ী, ২০ বছরের মধ্যে ডলারের মান এখন সবচেয়ে বেশি।
টাকার মান কমছেই
ইউএস ডলারের দাম আরো ৫০ পয়সা বেড়েছে। এতে টাকার মান আরেক দফা কমেছে। ফলে প্রতি ডলার কিনতে এখন গুনতে হবে ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা। গত বৃহস্পতিবার প্রতি ডলারের আন্ত ব্যাংক বিনিময়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা, আগে যা ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। এটি চলতি বছরে টাকার ১৯তম অবমূল্যায়ন। বৃহস্পতিবার আমদানির জন্য গ্রাহকের কাছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে ৯৪ টাকা করে, যা এক সপ্তাহ ধরে ৯৩ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করেছিল।বৃহস্পতিবার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতি ডলারের দাম ধরা হয় ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা।
টান পড়ছে রিজার্ভে
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো কমেছে। গত সপ্তাহের শেষ দিনে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯.৭০ বিলিয়ন ডলারে। গত সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সঙ্গে ১.৯৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আমদানি পেমেন্ট নিষ্পত্তি করেছে বাংলাদেশ। আমদানির অর্থ পরিশোধের অনুমোদন দেওয়ার পর কমে গেছে রিজার্ভ। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ কমতে কমতে এখন দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো চার হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে গেছে।
বাজার পরিস্থিতি
গতকাল রাজধানীর গুলশান, মতিঝিল, পল্টনের মানি এক্সচেঞ্জে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১০১ টাকা দরে বিক্রি করা হয়েছে। তার পরও পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করতে পারছে না মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো।জানতে চাইলে রাজধানীর গুলশানের মেট্রো মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘গত সপ্তাহেই শেষ দুই-তিন দিনে ডলারের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমরা এর আগে ৯৭-৯৮ টাকায় বিক্রি করলেও এখন ১০০ টাকার বেশিতে বিক্রি করছি। ডলারের সরবরাহ কমে যাওয়ায় বেশি দামে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে।মানি চেঞ্জার ও খোলাবাজারের মুদ্রা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ দেশের বাইরে ঘুরতে বা চিকিৎসার কাজে যাচ্ছে। ফলে ডলারের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় ডলারের সরবরাহ কম। এই কারণে সংকট তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমদানির প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। অন্যদিকে রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে গেছে। যদিও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু আমদানির প্রবৃদ্ধি আরো বেশি। সেখানেও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। স্বভাবতই ডলারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম,তাই দাম বাড়ছে। এতে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ কমে যাচ্ছে—এসব ঝুঁকি প্রশমন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক একা করতে পারবে না, সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব সার্কুলার দিচ্ছে—এগুলো সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না, তার ওপর নজরদারি রাখতে হবে। খোলাবাজার থেকে ডলার কেউ জমিয়ে রাখছে কি না, আবার সেই টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটাও নজরদারিতে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। ’
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ গতকাল বলেন, ‘আমরা বেশ চাপের মুখে আছি, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে ডলারের সমস্যার সমাধান করতে না পারলে আমরা সংকটে পড়ে যাব, যদি শক্ত হাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারি। ’
ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আলী রেজা ইফতেখার গতকাল বলেন, ‘আমরা মাসখানেক ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা নিয়ে বৈঠক করে আসছি। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি সার্কুলার জারি করেছে। এতে আমরা আশা করছি আরো বাড়তি এক বিলিয়ন ডলারের মতো ডলার বাজারে যোগ হবে। এটা আমরা রবি (আজ) অথবা সোমবার থেকে পাওয়ার আশা করছি। এতে হয়তো ডলারের দাম কিছুটা কমবে। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশ ব্যাংক আরো কিছু পদক্ষেপ নেবে। ’
যত পদক্ষেপ
আমদানি নিরুৎসাহ করতে ঋণপত্র খোলার সময় নগদ জমার হার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ দেশে যে রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে ভবিষ্যতের ছয় মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়ায় এবং রিজার্ভে টান পড়ায় এখন বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহ করতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য গাড়ি ও ইলেকট্রনিক পণ্যের ঋণপত্র খোলার সময় নগদ জমার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া ডলারের ব্যয় কমাতে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে দেওয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। আমদানিনির্ভর উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে যেগুলো জরুরি নয়, সেগুলোর বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে দেশে ডলারসংকট নিরসনে নতুন চার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা (এনওপি) হ্রাস, রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন, ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তর।বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, নতুন সিদ্ধান্তে প্রায় ১০০ কোটি ডলার বাজারে আসবে, যার ফলে ব্যাংকগুলোতে দীর্ঘদিন পর ডলার বেচাকেনা শুরু হবে। এখন শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে আর ব্যাংকগুলো কিনছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ডলারের দাম বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করছে না। ব্যাংকগুলো যে দামে লেনদেন করে, তার মধ্যে একটি দরকে বিবেচনায় নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজারের চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্য রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। ডলারের সরবরাহ বাড়াতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ’