ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর একক মুদ্রা হিসেবে আবির্ভাবের পর গত ২৩ বছরের মধ্যে বর্তমানে ডলারের বিপরীতে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে ইউরো। মাস চারেক আগেও যেখানে ১০০ ইউরোর বিপরীতে ১১৩ ডলার পাওয়া যেত, সেখানে বর্তমানে ডলার আর ইউরো এখন একই কাতারে। আর ইউরোর এই অবনমনের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান রপ্তানি বাজারটি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে ডলারে কিনে ইউরোপে ইউরোতে বিক্রি করা বায়াররা আর্থিক ক্ষতির শঙ্কায় রপ্তানি অর্ডার কমিয়ে দিতে শুরু করেছেন।
বাংলাদেশি পোশাকের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএ সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪২.৬ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৭ দেশে রপ্তানি হয়েছে ২১.৪০ বিলিয়ন ডলারের, যা মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশ। এর সঙ্গে ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়া যুক্তরাজ্যের ৪.৪৯ বিলিয়ন ডলার যোগ হলে শুধু ইউরোপেই বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ২৫.৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি। যা বাংলাদেশের বৈশ্বিক তৈরি পোশাক বাজারের ৬১ শতাংশ।
গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউরোপীয় ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনে মূলত মার্কিন ডলারে বিক্রি করেন ইউরোতে। এই দুই দরের মধ্যে তাঁরা সমন্বয় করে নেন। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সব কিছু পাল্টাতে থাকে। বিশেষ করে যুদ্ধের ব্যাপ্তি বাড়ার পাশাপাশি ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে রাশিয়ার গ্যাস, তেল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার পাল্টা ব্যবস্থায় চরম সংকটে পড়ে জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালির মতো পরাশক্তিগুলো। এর প্রভাব পড়ে ইইউর একক মুদ্রা ইউরোতে। চাঙ্গা হয়ে ওঠা ডলারের বিপরীতে পড়তে শুরু করে ইউরো। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রতি ১০০ ইউরোর বিপরীতে ১১৩.৪৮ ডলার পাওয়া যেত। কিন্তু সাড়ে চার মাস পর গতকাল রবিবার ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক যে রেট প্রকাশ করেছে তাতে, এক ইউরোর বিপরীতে ১.০০৫৯ ডলার অর্থাৎ ১০০ ইউরোর বিপরীতে ১০০.৫৯ ডলার পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৯৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা হিসেবে আবির্ভাবের পর এমন দুরবস্থায় পড়তে হয়নি ইউরোকে। ডলারের বিপরীতে ইউরোর প্রায় ১১ শতাংশ অবনমনের খেসারত দিতে হবে ইউরোপিয়ান বায়ারদের।
এর কারণ হিসেবে বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাছির উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এমনিতেই কমে গেছে। এই সময় ইউরোর অবনমনে বায়াররা চাইলে পণ্যের দামও বাড়াতে পারবেন না। আর বর্তমানে ডলার রেটে কিনে ইউরোয় বিক্রি করলে তাঁদের বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হবে। ’
একই কথা বললেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি ও প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে সব মার্কেটই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সাধারণত ইউরোপে শীতের সময় ক্রিসমাসকে সামনে রেখে পোশাক বিক্রি খুব ভালো হয়। কিন্তু গ্যাস সরবরাহের সমাধান না হলে ইউরোপের আগামী শীত হবে খুবই বিপর্যয়কর। ডলারের বিপরীতে ইউরোর অবমূল্যায়ন হওয়ার কারণে পোশাকের দাম আরো বেড়ে যাবে। ’
বিজিএমইএর সহসভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘গত দুই মাস ধরেই টের পাচ্ছিলাম অর্ডারের গতি কমে আসছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনীতি এখন চাপের মুখে। এসব দেশে তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার খরচও বেড়ে গেছে। মানুষ দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে গিয়ে বিলাসপণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে।