ভারতের উত্তর সিকিমে ভয়াবহ আকস্মিক বন্যায় তিস্তা নদীর বাঁধ ভেঙে বাংলাদেশে প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে পানির ভারী ঢল। তিস্তা অববাহিকায় বিপত্সীমা অতিক্রম করছে পানির স্তর। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা নদী বেষ্টিত উত্তরের জেলা রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় ভয়াবহ বন্যার সতর্কতা জারি করেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ভয়াবহ স্বল্পকালীন বন্যা দেখা দিতে পারে। গতকাল বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত বিপত্সীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল সকাল থেকেই তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে এই অঞ্চলে টানা ভারী বর্ষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা থাকায় পাঁচ জেলার জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা পাড়ের বাসিন্দাদের সতর্ক করতে মাইকিং করছে। একই সঙ্গে চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের নিরাপদে স্থানে সরে যেতে বলছেন তারা। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। অসময়ে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কায় নদী পাড়ের মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অনেকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে শুরু করেছে।
ভারতের সংবাদমাধ্যম বলা হয়েছে, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জলপাইগুড়ি জেলায় তিস্তা নদীর পানি ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কালিম্পংয়ে ১০ নম্বরের জাতীয় সড়ক ভেসে গেছে। সেখানকার বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ধসের কারণে বাংলা-সিকিমের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। চুংথাং ড্যাম ভেঙে যাওয়ায় তিস্তার পানিতে সিকিমে বন্যা পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। জলপাইগুড়িতে রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। বন্যায় ভেসে গেছে ভারতীয় ২৩ সেনা। ধসে গেছে সেখানকার সেনা ছাউনি। ভারতীয় আবহাওয়া সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী শনিবার পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এই পানি ভাটিতে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বড় বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে সাগরে লঘুচাপের প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলোতে টানা ভারী বর্ষণ চলছে। এতে করে স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ঢাকা থেকে বরগুনা লঞ্চ চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। আবহাওয়ার বুলেটিনে সারা দেশে আরও তিন দিন বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সাগর উত্তাল থাকায় টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে পর্যটকবাহী জাহাজসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে দ্বীপে রাত্রি যাপনে থেকে যাওয়া প্রায় দুই শত পর্যটক আটকা পড়েছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বঙ্গোপসাগরসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর সমূহকে পুনরায় ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
রংপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার গোলাম মোস্তফা আনছারী জানান, অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল সেই সঙ্গে ভারতের উজানে মারাত্মক পানি বৃদ্ধির কারণে তিস্তা নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এর প্রভাবে তিস্তা নদীর পানি সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করতে পারে এ আশঙ্কায় রংপুরের গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া উপজেলার চরাঞ্চলে বসবাসকারী ৫০টি গ্রামের ৭০ হাজার পরিবারকে বাড়িঘর ছেড়ে মালামাল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে গতকাল দুপুর থেকে মাইকিং শুরু করেছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
ডিমলা (নীলফামারী) সংবাদদাতা সহিদুল ইসলাম জানান, নীলফামারীর ডিমলায় ভারী বৃষ্টি ও উজানের সিকিমের একটি বাঁধ ভেঙে পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়ে পড়েছে নদীর তীরবর্তী এলাকা উপজেলার খগা খড়িবাড়ী, খালিশা চাপানী, টেপা খড়িবাড়ী, ঝুনাগাছ চাপানী, পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নসহ বেশকিছু এলাকায়। নদীর আশপাশের পরিবারগুলো পানিবন্দিসহ কৃষিখেত তলিয়ে রয়েছে পানির নিচে। সেখানকার মানুষ গরু ছাগল হাঁস মুরগি নিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যাচ্ছে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার সতর্কতা নিয়ে মাইকিংসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চরবাসীদের উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় নৌকা প্রস্তুত ও ৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার কথা জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। সম্ভাব্য বন্যার আশঙ্কায় তিস্তার চর ও তীরবর্তী এলাকার মানুষের মধ্যে এখন বিরাজ করছে আতঙ্ক।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি এস এম শফিকুল ইসলাম জানান, উজান থেকে কয়েক ফুট উচ্চতায় প্রবল বেগে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে পানি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিস্তা পাড়ের বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। রংপুর অঞ্চলসহ লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম এলাকায় রাত থেকেই বৃষ্টি চলছে।
খুলনায় অবিরাম বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত
খুলনা অফিস থেকে এনামুল হক জানান, খুলনায় গত তিন দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কখনো ভারী, আবার কখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। বিরামহীন বৃষ্টির কারণে শ্রমজীবী মানুষ কাজের জন্য বাইরে বের হতে পারছে না। ফলে তাদের সংসারে খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।
খুলনা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, লঘুচাপের প্রভাবে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গত সোমবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত খুলনায় ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ বৃষ্টিপাত শুক্রবার থেকে কমতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বরিশাল নগর জুড়ে জলাবদ্ধতা
বরিশাল অফিস থেকে শাহীন হাফিজ জানান, বরিশালে ভারী বৃষ্টিপাতে জনগুরুত্বপূর্ণ একাধিক সড়কে এখনো হাঁটুপানি থাকায় জনসাধারণ চরম ভোগান্তিতে রয়েছে। গতকাল বুধবার দিনভর বৃষ্টিতে ভোগান্তি এড়াতে সড়কে মানুষের উপস্থিতি ছিল কম। ভোগান্তি এড়াতে কর্মজীবী ও জরুরি কাজ ছাড়া কেউ বাইরে বের হননি। অনেক সড়কে বেশি পানি থাকায় সেখানে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। এছাড়া নগরীর অধিকাংশ টিনের ঘর, অর্ধপাকা এবং পাকা ভবনের নিচতলা পানিতে তলিয়ে থাকায় দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ৭৬ দশমিক ০৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে অধিকাংশ সড়কে পানি জমে যায়। নগরীর বটতলা থেকে হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা সড়ক, করিম কুটির লেন, পুলিশ লাইন রোডস্থ আমবাগান লেন, বটতলা আদম আলী হাজির গলি, অক্সফোর্ড মিশন রোড, কলেজ এভিনিউ, গোরস্থান রোড, বগুড়া রোড, বিএম স্কুল সড়ক, রূপাতলী হাউজিং, ধান গবেষণা সড়কের খ্রিষ্টান কলোনি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপাদা কলোনি, পার্শ্ববর্তী শেবাচিম হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণি স্টাফ কোয়ার্টার, কালুশাহ সড়ক, কাজীপাড়া এবং কাউনিয়া এলাকার বেশ কিছু সড়কে পানি জমে আছে।
এইচ এম দুলাল, মোংলা (বাগেরহাট) সংবাদদাতা জানান, মোংলায় টানা বৃষ্টিপাতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টিতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দিনমজুর ও শ্রমিক-কর্মচারীরা। এদিকে বৃষ্টিপাতে পৌর শহরসহ উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি। ঘরবাড়ি তলিয়ে রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে গেছে অনেক পরিবারের। রাস্তা ও ঘরে পানি ওঠায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মঙ্গলবারের দিন-রাতের টানা বৃষ্টিপাতে মোংলা বন্দর ও পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এছাড়া বুধবার ভোর থেকে কখনো একটানা আবার কখনো কখনো থেমে থেমে হালকা-মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে মোংলার উপকূল জুড়ে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা মোহসীন পারভেজ জানান, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কলাপাড়ায় ৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। তবে বুধবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি। এতে স্থবিরতা নেমে এসেছে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে। ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। এদিকে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর বেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে। বাতাসের তীব্রতা কিছুটা বেড়েছে। নদনদীর পানির উচ্চতা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।