মনে রাখতে হবে এটা (ওয়ানডে) এমন একটা ফরমেট,যেখানে আমাদের গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে। আমরা এই ফরমেটে অনেক ভাল দল,কোন সন্দেহ নেই।কিন্তু যত ভাল খেলি না কেন,নির্দিষ্ট দিনে সব দিক থেকেই ভাল খেলতে হবে-এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।এখানে সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে,শুধু আমি নই,সবাই জাতীয় দলের হয়ে দেশের জন্য খেলছে।কথাগুলো তামিম ইকবাল বলেছিলেন উইন্ডিজে ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগে। সাকিব আল হাসান সাদা পোশাকের নেতৃত্বে ফেরার পর এই সফরে এটি ছিল প্রথম টেস্ট সিরিজ।সেখানে সম্ভাব্য সেরাদের নিয়েও দাঁড়াতে পারেনি বাংলাদেশ।অসহায় আত্মসমর্পণে হোয়াইটওয়াশ ২-০ ব্যবধানে।মাহমুদুল্লাহর অধীনে টি২০ দলটা ছিল তারকায় ঠাসা।সেখানেও হার সমান ২-০তে,প্রথম ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়।ভগ্নমনোরথে ঘুরে দাঁড়ানোটাই ছিল ‘চ্যালেঞ্জিং’।তার ওপর সাকিব,মুশফিকুর রহিম,ইয়াসির আলিরা নেই।তবু আত্মবিশ্বাসী ছিলেন অধিনায়ক এবং নিজেদের প্রিয় ফরমেটে ঠিকই জ্বলে ওঠে টাইগাররা।ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করে ৩-০ ব্যবধানে।ওয়ানডেতে স্বপ্নের ক্রিকেট খেলছে বাংলাদেশ।এখনও কোন বৈষয়িক শিরোপা জেতা হয়নি।একটি মাত্র ট্রাই নেশন ট্রফি।পঞ্চাশ ওভারের ফরমেটে টাইগারদের এভাবে বিচার করার সুযোগ নেই।দুটি এশিয়া কাপের ফাইনাল,একটি বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল,চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল,র্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো পরাশক্তিকে পেছনে ফেলা,টানা ছয়টি দিপক্ষীয় সিরিজ জয়-মাশরাফি বিন মর্তুজার অধীনে এ সবই দেখেছে বাংলাদেশ।তামিম দায়িত্ব নেয়ার পর এটি টানা পঞ্চম সিরিজ জয়।আগামী বছর ভারতে বসবে ওয়ানডে বিশ্বকাপের আসর।ক্রিকেটপ্রেমীরা সেখানে বড় স্বপ্ন দেখতেই পারেন।
সাকিব,মুশফিকের মতো বড় তিন পারফর্মারকে ছাড়াই এই সিরিজে ভাল করেছে টাইগাররা।সেখানে জ্বলে উঠেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ,নাসুম আহমেদ,নুরুল হাসান সোহানের মতো তরুণরা।সুতরাং বিশ্বকাপে দারুণ একটা কম্বিনেশন গড়ে ওঠার আশায় সবাই।সাকিব আল হাসান থাকলে নাসুম আহমেদ হয়তো সুযোগই পেতেন না।টি২০ অভিষেকের প্রায় পনেরো মাস পর ওয়ানডেতে সুযোগ পান নাসুম।আর নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই করেন বাজিমাত। বড় তারকার অনুপস্থিতিতে পাওয়া সুযোগটা কি দারুণভাবেই না কাজে লাগিয়েছেন।গায়ানায় প্রথম ম্যাচে ৮ ওভারে ৩ মেডেন,মাত্র ১৬ রান দিয়ে ছিলেন উইকেটশূন্য।
এবার নিজেকেই ছাড়িয়ে গেছেন।সিরিজ নিশ্চিতের দিনে নায়ক বনে গেছেন সিলেট থেকে উঠে আসা ২৭ বছর বয়সী বাঁহাতি এ স্পিনার।মেহেদী হাসান মিরাজ ৪ উইকেট পেলেও টার্নিং টাইমে ৩ উইকেট নিয়ে ক্যারিবীয়দের ব্যাটিংয়ের মেরুদ-টাই ভেঙ্গে দিয়েছেন নাসুম।১০ ওভারের ৪টিই মেডেন।রান দিয়েছেন মাত্র ১৯।৯ উইকেটের জয়ের ম্যাচে তাই ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠেছে নাসুমের হাতে।তাইজুলের গল্পটা আরও স্মরণীয়,ব্যতিক্রম।দ্বিতীয় ম্যাচে সিরিজ নিশ্চিতের পরই অধিনায়ক তামিম বলেছিলেন,সাকিব থাকলে সে (নাসুম) সুযোগ পায় না।আমার মনে হয় ওর এই পারফর্মেন্স অবিশ্বাস্য।কথাটা শুধু নাসুম নয় আরও অনেকের বেলায় সত্য।দলের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার যদি হন বাঁহাতি স্পিনার, তখন ম্যানেজমেন্টের আর কি-ই বা করার থাকে!ওয়ানডেতে তাইজুল ইসলামের বিস্ময়ের ঘোর লাগানো প্রত্যাবর্তন।
সেটাও সাকিবের অনুপস্থিতি এবং গায়ানার স্পিনিং পিচের সৌজন্যে!প্রথমে নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ,দ্বিতীয় ম্যাচে নাসুম,সিরিজও নিশ্চিত।শরিফুল ইসলামকে বাইরে রেখে তাই একাদশে দুই বাঁহাতি স্পিনার।গোটা সফরে সাইড বেঞ্চে বসে থাকাতাইজুল ইসলাম কী জবাবটাই না দিলেন!দুই বছরেরও বেশি সময় পর ওয়ানডেতে ফিরেই নায়ক ভাগ্যবিড়ম্বিত এ ক্রিকেটার।১০ ওভারে ২ মেডেন, ২৮ রানে ৫ উইকেট নিয়ে হলেন ম্যাচসেরা!
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে বাংলাদেশ ছয়টি সিরিজের মধ্যে তিনটিই জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে,তিনটি ঘরের মাটিতে।২০০৯ সালে সাকিবের নেতৃত্বে,২০১৮ সালে মাশরাফি এবং ২০২২ সালে তামিমের নেতৃত্বে।শুধু তা-ই নয়, ক্যারিবিয়ীদের বিপক্ষে এ নিয়ে টানা ১০টি ওয়ানডে ম্যাচ জেতারও কীর্তি গড়েছে বাংলাদেশ।জিম্বাবুইয়ের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এমন রেকর্ড।উইন্ডিজের বিপক্ষে সব মিলিয়ে ৪৩ দেখায় ২০তম ওয়ানডে ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ।এর চেয়ে বেশি,অর্থাৎ ৫০টি ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের রেকর্ড আছে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে।
নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে উইন্ডিজের বিপক্ষে এটি ছিল বাংলাদেশের ৮০তম একদিনের সিরিজ।এর মধ্যে জিতেছে ৩২টিতে।এই ৩২টির মধ্যে আবার ১৬টিতে প্রতিপক্ষকে করেছে হোয়াইটওয়াশ। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি হোয়াইটওয়াশ করেছে জিম্বাবুইয়েকে,৬ বার।এরপর উইন্ডিজকে ৩ বার।কেনিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে দুইবার করে। একবার করে পাকিস্তান,আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডকে।বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৩৯৭টি ওয়ানডে খেলে খেলে জয়ী হয়েছে ১৪৩টিতে। এর মধ্যে প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করে জয় পেয়েছে ৫১টিতে।বাংলাদেশের হোয়াইটওয়াশ করা সিরিজগুলোর মধ্যে আছে পাঁচ ম্যাচের সিরিজও।পাঁচ ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশের সাফল্য দুইবার।দু’বারই প্রতিপক্ষ ছিল জিম্বাবুইয়ে।
প্রথমে ২০০৬ সালে,পরে ২০১৪ সালে।৪-০ ব্যবধান ছিল দু’বার।এর মধ্যে চমক ছিল ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করা।পরে যা বিশ্ব ক্রিকেটে পরিচিতি পেয়েছিল ‘বাংলাওয়াশ’ নামে। এই সিরিজ অবশ্য ৫ ম্যাচের ছিল।কিন্তু বৃষ্টির কারণে দ্বিতীয় ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছিল।৪-০ ব্যবধানে জেতা অপর প্রতিপক্ষ ছিল কেনিয়া। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের এই অর্জন ছিল প্রথম কোন প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করা।বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করেছে তিন ম্যাচের সিরিজে ১০ বার।জিম্বাবুইয়েকে ৪ বার (২০১৫,২০১৮,২০২০ ও ২০২১),উইন্ডিজকে ২ বার(২০০৯,২০২১)এবং একবার করে কেনিয়া (২০০৬),আয়ারল্যান্ড (২০০৮),নিউজিল্যান্ড (২০১৩) ও পাকিস্তান (২০১৫)।২-০ ব্যবধানে সিরিজ ছিল একটিই।প্রতিপক্ষ ছিল ২০০৬ সালে স্কটল্যান্ড।সত্যি ওয়ানডে সাফল্যের অতীত মন ভরিয়ে দেয়।
মন ভরিয়ে দেয় অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি ও তামিমের সাফল্যও।২০১৪ থেকে ২০২০ মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে দারুণ সব সাফল্য তুলে নেয় বাংলাদেশ।২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল,টানা ৬টি দিপক্ষীয় সিরিজ জয়।সত্যি সোনালি সময়।ম্যাশের আর্মব্যান্ড এখন তামিমের হাতে।টেস্ট ও টি২০তে খেই হারানো বাংলাদেশ পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে সমানে দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে।তামিমের নেতৃত্বে ছয় সিরিজের পাঁচটিতেই জয়।পরিসংখ্যান,মাঠের ক্রিকেট,ফল সবকিছুই বলে ওয়ানডে ফরমেটে সত্যি দুর্দান্ত এক দল বাংলাদেশ।২০১৪ সালের নবেম্বর-ডিসেম্বরে জিম্বাবুইয়েকে ৫-০ ব্যবধানে হারিয়ে শুরু হয়েছিল মাশরাফি-যুগ।
এরপর অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার-ফাইনাল।বিশ্বকাপের পর একের পর এক সিরিজে অভাবনীয় সাফল্য মেলে পাকিস্তান,ভারত,দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।মাশরাফির নেতৃত্বে সে সময় টানা ৬টি দ্বিপক্ষীয় সিরিজ জেতে দল,এখনও যা বাংলাদেশের রেকর্ড।সাফল্যের সেই ধারা চলতে থাকে পরেও।২০১৭ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমি-ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ।২০১৮ এশিয়া কাপে খর্বশক্তির দল নিয়েও উঠে যায় ফাইনালে।সিরিজ জয় ধরা দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজে।২০১৯ বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ মেলে প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফিজয়ের স্বাদ।তবে ২০১৯ বিশ্বকাপে মাশরাফি নিজে ব্যর্থ হন বোলিংয়ে, দল পারেনি প্রত্যাশা পূরণ করতে।
২০২০ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে শেষ হয় ম্যাশের নেতৃত্বের অধ্যায়।তার উত্তরসূরি তামিমের দায়িত্ব ছিল ওয়ানডেতে দলের সাফল্যযাত্রা ধরে রাখা এবং দলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।নতুন উচ্চতায় নিতে পারবেন কিনা,সেটি বোঝা যাবে আগামী বছর।তবে এই ওপেনারের নেতৃত্বে ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে দল।সুপার লীগের ১৮ ম্যাচে সর্বোচ্চ ১২ জয়ে টাইগারদের ২০২৩ বিশ্বকাপে খেলা অনেকটাই নিশ্চিত।