রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের গতি কমে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। বিপুলসংখ্যক কর্মী বিদেশে গেলেও সেই অনুযায়ী প্রবাসী আয় আসছে না। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে একাধিক বিনিময় হার চালু হওয়ায় প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিনিময় হার এখনো বাজারভিত্তিক হয়নি, যা রিজার্ভ কমাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থাকে এভাবেই দেখছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, এ দেশের অর্থনীতিতে এখন চার ধরনের সংকট রয়েছে ও তা উত্তরণের চ্যালেঞ্জও আছে। এগুলো হলো, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির চাপ, আর্থিক খাতের ঝুঁকি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা।
২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেই রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৭৪ কোটি (২৬ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন) ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ বর্তমানে ২ হাজার ৯০ কোটি (২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন) ডলার। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না। গত দুই বছরে প্রতি মাসেই রিজার্ভ গড়ে ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার করে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে প্রকৃত রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে শুধু তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে, অন্য কোনো খরচ নয়। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। বর্তমানে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে রয়েছে। এই দলের আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে রিজার্ভের পতন ঠেকানোসহ শর্ত পূরণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা। অর্থনীতিবিদের মধ্যেও দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হওয়ায় রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। রিজার্ভ যত কমে যায়, টাকা তত মান হারায়।
বিশ্বব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে পারলে এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক করা সম্ভব হলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি। আগামী দিনেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। এটি নির্ভর করবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য কেমন থাকে, এর ওপর।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস হলো, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশ থাকতে পারে। এর মানে, চলতি অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছে না বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যা আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণগুলো হলো—দেশের বাজারের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি; দুর্বল মুদ্রানীতি; টাকার অবমূল্যায়ন; সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন এবং কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। মানুষের ভোগ চাপের মুখে পড়েছে। মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় খাবারের দাম বেশি বেড়েছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। তাদের কেনার সামর্থ্য কমেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ আসছে বিশ্লেষকদের কাছ থেকে।
বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জ্বালানির উচ্চমূল্য, দুর্বল মুদ্রানীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, পণ্যের সরবরাহ সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। একই সঙ্গে মজুরি না বাড়ায় মানুষের ভোগব্যয় কমছে, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ অন্য ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। এমতাবস্থায় কাঠামোগত সংস্কারের সুপরিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশে বিদ্যমান সমস্যার কারণে, নাকি বৈশ্বিক কারণে এমন প্রশ্নও রয়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব সব দেশেই বিদ্যমান থাকে। কিন্তু সে পরিস্থিতির সঙ্গে দেশীয় পলিসি অ্যাডজাস্ট বা সমন্বয় করে সমস্যার সমাধান করতে হয়।