মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটে সশস্ত্র বিতর্কিত সংগঠন আরসার পক্ষে কাজ করার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিব্বুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছিল। র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার আরসার শীর্ষ নেতা নুর কামাল ওরফে সমিউদ্দীন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এই তথ্য জানিয়েছেন।
সোমবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানান র্যাব হেডকোয়ার্টারের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
রোববার রাতে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শরনার্থী শিবির সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৭টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদসহ রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সমন্বয়কারী ও হত্যাকারী এবং মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার মোস্ট ওয়ান্টেড কিলার গ্রুপের প্রধান নুর কামাল ওরফে সমিউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
প্রেস ব্রিফিংয়ে খন্দকার আল মঈন জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন এবং রোহিঙ্গাদের শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখছিলেন মাস্টার মুহিব্বুল্লাহ।
এ সময় আরসা প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনি মাস্টার মুহিব্বুল্লাহকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসার সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের স্বদেশে শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনে বিরোধিতা করেন আতাউল্লাহ। তার কথায় রাজি না হওয়ায় আতাউল্লাহ জুনুনি মাস্টার মুহিব্বুল্লাহকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
মাস্টার মুহিব্বুল্লাহর হত্যার দুদিন আগে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কুতুপালং শরনার্থী শিবিরের একটি বাড়িতে বৈঠক করেন আরসার সন্ত্রাসী গ্রুপ। দুদিন পর ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে আরসার ১২ জন কিলার গ্রুপ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মাস্টার মুহিব্বুল্লাহর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে নুর কামাল জানান মাস্টার মুহিব্বুল্লাহকে তার কার্যালয়ে যে গ্রুপ সরাসরি গুলি করে হত্যা করে সেই গ্রুপেই নুর কামাল উপস্থিত ছিলেন। গ্রেপ্তার নুর কামাল মাস্টার মুহিব্বুল্লাহ হত্যা মামলার ১৯ নাম্বার চার্জশিটভুক্ত আসামি বলে জানিয়েছেন তিনি।
খন্দকার আল মঈন আরও জানান, নাইকংছড়ি সীমান্তে মাদকবিরোধী অভিযানে ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা হত্যা এবংর্যাব সদস্য আহত হওয়ার ঘটনায় এই নুর কামাল জড়িত। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কয়েকজন মাঝিসহ একাধিক হত্যাকাণ্ড, অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনায়ও জড়িত রয়েছেন নুর কামাল।
তিনি জানান গোপন সংবাদে খবর পেয়ে র্যাব ১৫-এর একটি টিম রোববার রাতে কুতুপালং শরনার্থী শিবিরের একটি গোপন আস্তানায় অভিযান চালায়।র্যাবের দল উক্ত আস্তানা ঘেরাও করে আরসা নেতা নুর কামাল সমিউদ্দীনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় উক্ত আস্তানায় তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানায়, গ্রেপ্তারকৃত সমিউদ্দিন জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক। তিনি ২০১৬ সালে মিয়ানমারে অবস্থানকালীন সময়েই আরসার কমান্ডার আব্দুল হালিম, মাস্টার নুরুল বশর ও আবু আনাসের মাধ্যমে আরসায় যোগদান করে এবং মিয়ানমারে আরসার হয়ে ১ বছর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেয়। পরে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে শরণার্থী ক্যাম্প-৭ এ বসবাস শুরু করে। ২০১৮ সালের দিকে আরসার কমান্ডার মুফতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে পুনরায় আরসার নতুন করে সদস্য সংগ্রহ, লোকবল বৃদ্ধিসহ সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। পর্যায়ক্রমে ৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরসার ব্লক জিম্মাদার, হেড জিম্মাদার এবং সর্বশেষ ক্যাম্প কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব লাভ করে। নুর কামাল আরসা প্রধান আতাউল্লাহর নির্দেশে আরসার ভয়ংকর ও সক্রিয় সদস্যদের নিয়ে ২০ জনের একটি গান গ্রুপ তৈরি করে যা ‘কিলার গ্রুপ’ নামে পরিচিত। উক্ত কিলার গ্রুপের প্রধান হিসেবে নিজে দায়িত্ব পালন করতো। এই গ্রুপটি বিভিন্ন সময়ে টার্গেট কিলিং সম্পন্ন করার পাশাপাশি তাদের কথামতো কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ভিকটিমকে অপহরণপূর্বক শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনসহ মুক্তিপণ আদায় করতো। মুক্তিপণ না পেলে তার নেতৃত্বে কিলিং মিশন সম্পন্ন করতো এবং ভিকটিমকে খুন করে গহীন পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে লাশ গুম করতো বলে জানা যায়। এ ছাড়াও তার নেতৃত্বে ‘আরসা’র কিলিং গ্রুপের সদস্যরা রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে হত্যা, হামলা, ভয় ভীতি প্রদর্শন, অরাজকতা ও আতঙ্ক সৃষ্টিসহ খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। সে ক্যাম্প-১, ২, ৬ ও ৭ এর আরসার ‘গান গ্রুপ’ কমান্ডার হিসেবেও নেতৃত্ব প্রদান করতো। তার নেতৃত্বে নগদ অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্রয় করা হতো। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তার নেতৃত্বে আরসার প্রধান আতাউল্লাহর নির্দেশে পার্শ্ববর্তী দেশ হতে দূর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ চোরাচালান করতো বলে জানায়। এ ছাড়াও অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনে গ্রেপ্তারকৃত সমিউদ্দিন কিলার গ্রুপের সদস্য ও আরসার অন্যান্য সন্ত্রাসীদের মাঝে সরবরাহ করতো বলেও স্বীকার করে। তাদের অত্যাচারে শরনার্থী শিবিরের শরনার্থীরা সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তারা তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করতো বা অপহরণের পর লাশ গুম করতো বলে জানা যায়।
ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃত সমিউদ্দিন মায়ানমারে থাকাকালীন সময়েও বিভিন্ন হত্যা, হামলা, অস্ত্র লুটপাট, সহিংসতাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। সে মিয়ানমারে থাকাকালীন ২০১৬ সালে আরসার হয়ে বিজিপি (মায়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ) ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে বেশকিছু অস্ত্র লুট করে এবং বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে।
পরে আরসার প্রধান আতাউল্লাহর নির্দেশে গ্রেপ্তারকৃত নুর কামাল প্রকাশ সমিউদ্দিন ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সমন্বয় করে ও সরাসরি অংশগ্রহণ করে। গ্রেপ্তারকৃত সমিউদ্দিনসহ প্রায় ১২ জনের একটি দল দুভাগে বিভক্ত হয়ে মাস্টার মহিবুল্লাহর অফিসে প্রবেশ করে মহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে বলে জানা যায়। পরবর্তী তারা সেখান থেকে আত্মগোপনে চলে যায়। এ ছাড়া ২০২২ সালের নভেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। উক্ত সন্ত্রাসী হামলায় একজন র্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন। উক্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সেও সরাসরি জড়িত ছিল বলে জানা যায়।
২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কুতুপালং শরনার্থী শিবিরে নিজ কার্যালয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটসের সভাপতি মাস্টার মুহিব্বুল্লাহ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।
উখিয়া থানা পুলিশ ২০২২ সালের ১৩ জুন ২৯ জনের নাম উল্লেখ করে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনিসহ আরও ৭ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। বর্তমানে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মুহিব্বুল্লাহ হত্যা মামলাটি স্বাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।