মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে সংঘাতের ঘটনা ঘটলেই তার রেশ বয়ে যায় বিশ্ব অর্থনীতিতে। অতীত ইতিহাস সে কথাই বলে। এরূপ বাস্তবতায় ইসরাইল-হামাস সংঘাতের হাত ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে ‘মন্দা অবস্থা’ শুরু হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই সংঘাত তীব্রতর হলে তথা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এতে জড়িয়ে পড়লে বিশ্বব্যাপী ‘তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা’ দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশ্ব অর্থনীতিতে এই যে ঝুঁকির আশঙ্কা, একে বাস্তবসম্মত চিন্তা হিসেবে না মেনে উপায় নেই। এই কথা বলার কারণ, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলার জবাবে ইসরাইলের সেনাবাহিনী গাজায় বৃহত্তর আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। হামাস ও ইসরাইলি বাহিনীর হামলা-পালটা হামলায় ইতিমধ্যে কয়েক হাজার লোক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। উপরন্তু, এমন উদ্বেগও রয়েছে—উভয় পক্ষের সমর্থনকারীরা যুদ্ধে যোগ দিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
আমরা জানি, ফিলিস্তিনের হামাস যোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তাকারী হিসেবে ইরানের নাম আসে বিভিন্ন সময়। এই অভিযোগ খোদ ইসরাইলের সমর্থনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের। অর্থাত্, চলমান সংঘাতে ইরানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেলে বিভিন্ন পক্ষের সরাসরি সংঘর্ষের মাঠে নেমে পড়ার আশঙ্কা অযৌক্তিক চিন্তা নয়, এবং সে ধরনের পরিস্থিতিতে জ্বালানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে চরম অস্থিতিশীলতা ও সংকট।
অনুমান করা যায়, জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১৫০ মার্কিন ডলারে উঠে যাবে, যা এখন অবধি ৯০-১০০ ডলারের ঘরে ওঠানামা করছে। চিন্তার বড় কারণ, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিও পড়বে মারাত্মক হুমকির মুখে। বলা হচ্ছে, ১.৭ শতাংশ নেমে যাবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার। অর্থাত্, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলমান মানবিক ট্র্যাজেডির পর উপর্যুক্ত উৎকণ্ঠাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আমরা লক্ষ করছি, উভয় পক্ষের হামলায় নিহত ও আহতদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। এই হানাহানির ঘটনায় জিম্মির ঘটনাও ঘটছে। আকাশ, নৌ ও স্থলপথ ব্যবহার করে যেসব হামলার ঘটনা ঘটছে, তাতে বিভিন্ন ছিটমহলে আটকে পড়া ফিলিস্তিনিদের জীবন ঢেকে যাচ্ছে অন্ধকারের চাদরে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনবাসীর জন্য পরিস্থিতি এমন, ‘পালানোর পথ নেই’।
ইসরাইল ভূখণ্ডে হামাসের রকেট হামলার পর পালটা হামলায় গাজায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী, তা কেবল তীব্র সংঘাতের শঙ্কাই বাড়াচ্ছে না; বরং তা বড় পরিসরে সামরিক শক্তি প্রয়োগের আশঙ্কাও বাড়ছে ক্রমাগতভাবে। অর্থাৎ, মধ্যপ্রাচ্যের এবারের সংঘাতের কারণে সারা বিশ্বে যে ধরনের অর্থনৈতিক ভূকম্পন সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার ফলে বিশ্বের বড় শিপিং লাইনগুলো অবরুদ্ধ হয়ে এই অঞ্চলের জন্য তো বটেই, গভীর সংকট ডেকে আনবে বিশ্ববাণিজ্যের জন্য।
মনে থাকার কথা, ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় তেল নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে বিশ্ববাজারে বড় ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ঐ সময় শিল্প অর্থনীতিতে নেমে আসে চরম স্থবিরতা। বছরের পর বছর ধরে চলা সেই মন্দা অবস্থা কাটাতে কতটা হিমশিম খায় দেশগুলো, তা ভোলার নয়!
সন্দেহ নেই, বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্বল-নাজুক অবস্থায় নিপতিত। প্রায় দুই বছর ধরে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে ব্যাপকভাবে। নানামুখী সংকটের মধ্যেই অর্থনৈতিক অঙ্গনে হাজির হলো নতুন সমস্যা—হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এই যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারলে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য তা বয়ে আনবে বড় ধরনের অভিশাপ।
মনে রাখা জরুরি, মধ্যপ্রাচ্য হলো জ্বালানি উৎপাদনের প্রধানতম অঞ্চল। এই অঞ্চলে সংঘাত সৃষ্টি মানে গোটা বিশ্বের জ্বালানি-সংকটের মুখে পড়া। এতে করে জ্বালানির প্রশ্নে এমন কঠিন সংকটের মুখে পড়বে বিশ্ব, যা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির পুনরুদ্ধারকে শুধু ব্যাহতই করবে না, করে তুলবে ‘অসম্ভব’।
বিশ্লেষকদের অভিমত, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এরপর হামাস-ইসরাইল সংঘাত—এই দুই সংকট আরব বিশ্বে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করলে তার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত প্রভাবিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের সময় ভোটারদের কাছে প্রতিবারই বড় বিষয় হয়ে ওঠে ‘পেট্রোলের দাম’। এই অর্থে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা এবং তা থেকে জ্বালানি-সংকট সৃষ্টি হলে তা আছড়ে পড়বে মার্কিন মুলুকেও!
ইসরাইলের সঙ্গে হামাস বা ফিলিস্তিনের সংঘাত বা যুদ্ধ নতুন নয়; তবে এবারের সংঘাতের সূত্র ধরে জ্বালানি-সংকট সৃষ্টি এবং তার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাপরিস্থিতি তীব্রতর হতে পারে বলে যে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, তার সপক্ষে তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা যায়—
এক. ২০১৪ সালে হামাস-ইসরাইল সংঘাতের ফলে ২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। সে সময় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বাইরে যুদ্ধ ছড়িয়ে না পড়ায় তেলের দামের ওপর তেমন একটা প্রভাব পড়েনি, কিন্তু এবারের হানাহানিতে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। তাছাড়া ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামলায় জড়িত থাকার বিষয়ে ইরানের সম্পৃক্ততা খুঁজতে কাজ করে যাচ্ছে। ইসরাইলে হামলার ঘটনায় ইরানের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তা বাইরের বিভিন্ন পক্ষকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলবে অনিবার্যভাবে, যার প্রভাব পড়বে জ্বালানি তেল তথা বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর।
উল্লেখ করার বিষয়, ইরানের তেল এমনিতেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে ওঠানামা করে। অর্থাত্, নতুন করে যদি মার্কিন অবরোধের মুখে পড়ে ইরান, তাহলে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি তিন থেকে চার ডলার বেড়ে যাবে রাতারাতি। এরপরের দিনগুলোতে তা কেবল বাড়তেই থাকবে।
দুই. চলমান হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ বড় ইস্যু হয়ে উঠলে তা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য। ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহার সঙ্গে ইসরাইলি বাহিনীর ইতিমধ্যে সীমান্তে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। এই সংঘাত যদি কোনোভাবে লেবানন ও সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ অবধারতিভাবে হয়ে উঠবে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’। এর ফলে অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি হবে ব্যাপকভাবে। মনে থাকার কথা, ২০০৬ সালে স্বল্প সময়ের রক্তক্ষয়ী ইসরাইল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধেই অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) ব্যারেল প্রতি পাঁচ ডলার বেড়ে যায়। অর্থাত্, আবারও তেমনটা ঘটলে তেলের দাম রাতারাতি ১০ ডলার থেকে ১৫ ডলার বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এমনকি উত্তেজনা বাইরে ছড়িয়ে পড়লে মিশর, লেবানন ও তিউনিসিয়ার মতো অঞ্চল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থবিরতার মুখে হাবুডুবু খাবে।
তিন. ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সব সময় বিপজ্জনক। এর ফলে বৈশ্বিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা অতি প্রবল। ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখে আসছে। রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক জোট গড়তে তেহরানের বিভিন্ন প্রচেষ্টা-পদক্ষেপও ইসরাইলের মাথাব্যথার বড় কারণ। এর মধ্যে আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ ইরানের অস্বস্তি বাড়িয়েছে। যেমনটা বলা হয়েছে আগে—হামাসের হামলায় ইরানের জড়িত থাকার বিষয়ে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র মিশ্র বার্তা পাঠিয়েছে। সুতরাং, সব মিলিয়ে পরিস্থিতিকে এখন পর্যন্ত বেশ ঘোলাটে বলতে হয়!
বড় ধরনের আশঙ্কার কথা, ইসরাইল ও ইরান যদি কোনোভাবে মুখোমুখি অবস্থায় চলে আসে, তাহলে তেলের দাম বেড়ে যাবে হুহু করে। যেমনটা ঘটেছিল ১৯৯০ সালে ইরাক-কুয়েত সংঘাতের সময়। আজকের দিনে সেই আশঙ্কা বহুগুণ বেশি! ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার পথে হাঁটে, তাহলে বিশ্বে দৈনিক তেল সরবরাহ কমে যাবে এক-পঞ্চমাংশ। এই পরিমাণ তেল কোনোভাবেই জোগান দেওয়া যাবে না অন্য কোনো মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের সংকট সৃষ্টি হয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে শুরু হবে মারাত্মক সংকট। বাস্তবতা হলো, মধ্যপ্রাচ্য এমন এক অঞ্চল, যেখানে সংকট সৃষ্টির অর্থই হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমাগত অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়া।