দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার চক্রে আটকে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। যে কারণে এই সেক্টরে মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু কেরানী আফজাল ও মালেক ড্রাইভারের মতো মানুষ তৈরী হয়েছে। অথচ যারা দিনরাত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন সেই চিকিত্সক ও নার্সরা রয়ে গেছেন অবহেলায়। তাদের নেই পদোন্নতি। আছে শুধু বঞ্ছনা আর ক্ষোভ। এই অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় মেধাবীরা এই পেশায় আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রনালয়ে সুপারিশ করা হলেও দিনের পর দিন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কারনেই এই ধরনের মিঠু চক্রে বন্দি হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা।
স্বাস্থ্যে মিঠু একটা আলোচিত নাম। তিনি কত কোটি টাকার মালিক সেটা ধারণা করাও মুশকিল। থাকেন আমেরিকায়। সম্পদ বেঁচতে দেশে এসে এবার আটকে গেছেন। মিঠুর সম্পদ জব্দ ও বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ফলে সহসাই আর দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারছেন না। ২০০৯ সাল থেকে তার স্বাস্থ্যে এই মিঠুদের উত্থান। কেনাকাটা থেকে নির্মান কাজ সবই করেন তিনি। এখন মিঠু কোনঠাসা থাকলেও তার লোকরাই কাজ করছে। ফলে মিঠু চক্রের মধ্যে জিম্মি হয়ে আছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
সিনিয়র ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ি,প্রশাসনিক পদে অন্য পেশার লোকজন থাকা। স্বাস্থ্য হল একটি বিশেষায়িত বিভাগ। সেখানে যদি অন্য পেশার লোকজন নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে এখানে তো মিঠুরাই আসবে। এই মিঠুদের মাধ্যমেই কোটি কোটি টাকার ন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। যা অনেক জায়গায় বাক্সবন্দি অবস্থায় রয়েছে। শুধু মিঠু নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেরানী আফজাল ও মালেক ড্রাইভারও শত কোটি টাকার মালিক। স্বাস্থ্য বিভাগে দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। একজন গাড়ি চালক কিভাবে এত টাকার মালিক হয়? কেরানী আফজালের দেশে বিদেশে রয়েছে কোটি কোটি টাকা। একজন সিবিএ নেতারও আছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এই চক্রের দাপটে হাসপাতালে কাজ করা কঠিন। এখানে দুর্নীতির কোন বিচার হয় না।
ঢাকার একটি হাসপাতালের একজন পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি হাসপাতালে বসেই মদ খান, নারী কেলেঙ্কারীর সঙ্গে যুক্ত। করোনার সময় তার বিরুদ্ধে কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ আছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। এর মধ্যে মন্ত্রনালয়ের দুই জন সচিব অবসরে গেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা হয় না। দুদকও তদন্ত করছে। তারও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। একাধিক হাসপাতালের পরিচালক নিজের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ব্যবসা করছেন। কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ ডাক্তার নার্সদের পদোন্নতি হয় না। একজন ডাক্তারকে প্রফেসর হতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। নার্সরাও বিএসসি , এমপিএইচ, পিএইডি করার পরও তারা সিনিয়র স্টাফ নার্স হয়ে পড়ে আছেন। এখন তারা মানষিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়ছেন।
এই পরিস্থিতিতে ডাক্তাররা প্রশাসনিক পদে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন। জড়িয়ে যাচ্ছে অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে। দলবাজ ও অযোগ্যরা পদোন্নতি পাচ্ছেন। এই অবস্থার কারণে ডাক্তারদের আশঙ্কা, দিন দিন এই পেশা মেধাশূন্য হয়ে যাবে। তারা বলছেন, নার্সিং অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনাও চলে গেছে অন্য পেশার হাতে। অথচ অবকাঠামোসহ রোগ নির্নয়ের সকল ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য বিভাগকে আন্তর্জাতিক মানের নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন। শেখ হাসিনা বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট ও শেখ রাসেল গ্যাস্টোলিভার ইনস্টিটিউটের মতো বিশেষয়িত হাসপাতাল এখানে আছে। এসব প্রতিষ্ঠান এশিয়াতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অথচ দুর্নিতী অব্যবস্থাপনার কারনে রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত রোগীরা অন্য হাসপাতালে রোগীরা কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না।
কয়েক মাস আগে একটি বেসরকারী হাসপাতালে একজন রোগীর লিভার ক্যান্সার হয়েছে, তাকে হার্টের রোগী বলে রিং পরিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এভাবে চলতে থাকলে এমনই ঘটবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে অন্য পেশার লোক আনা উচিত্ না। অন্য পেশার লোকের কারণে এখানে দুর্নীতি থামানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে ৪৫০টি বেসরকারী নার্সিং ইনস্টিটিউট ও কলেজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ১০-২০টা ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান মান সম্পন্ন না। তাদের নিজস্ব কোন জায়গা বা ভবন নেই। ৯৫ ভাগেই দু একটা রুম ভাড়া করে নার্সিং প্রশিক্ষনের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রশিক্ষিত নার্স তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এদের দ্বারা রোগীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাববনাই বেশি। মোটা অংকের টাকা দুর্নীতি করে এই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অবসরে যাওয়া দুই জন কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত। ইতিমধ্যে নাসিং কাউন্সিলের একজন রেজিস্টারকে দুর্নিতির জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘এখানে দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয়। সেখান থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অধিদপ্তরের যা করণীয় সেটা করা হয়। কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না।’