বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এখন খাদ্যসহ সব পণ্যের দাম হুহু করে বাড়ছে। জ্বালানির দাম বাড়ায় পণ্য পরিবহণের খরচও বাড়ছে। এতে সব পণ্যের দাম আরও বেড়েছে।
পণ্যের দাম বাড়ায় বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির পালে লেগেছে ভয়ানক হাওয়া। এতে বিশ্বব্যাপী সব পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানিনির্ভর দেশগুলো পণ্য আমদানির নামে এক ধরনের মূল্যস্ফীতি আমদানি করছে। এছাড়া পণ্যের দাম বাড়ায় মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির হারকে আরও উসকে দিচ্ছে। একদিকে পণ্যের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে মুদ্রার মান কমার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এর বাইরে অর্থনৈতিক মন্দায় অনেকে কর্ম হারিয়েছেন বা আয় কমেছে। ফলে চাহিদা, সরবরাহ ও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যের ব্যবধান প্রকট হয়েছে। এটি এ হার বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশই বিদ্যমান সংকটে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে যাদের আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি এবং সংকটেও রপ্তানি টিকে আছে, তারাই কম আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অন্যতম। তারা জ্বালানি তেল ও অন্যান্য খনিজসম্পদ রপ্তানি করে ভালো বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন। ফলে সৌদি আরবসহ অনেক দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে বেড়েছে। অথচ অন্য দেশগুলোর মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমেই যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মূলত করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময়ে বিশ্বব্যাপী পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ওই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকলে পণ্যের সরবরাহ সংকটজনিত কারণে দাম বাড়তে থাকে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পণ্যের সরবরাহ সংকট যেমন বেড়ে যায়। তেমনই দামও বাড়তে থাকে। আমদানি পণ্যের দাম বাড়ায় মুদ্রার দাম কমতে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে জ্বালানি পণ্য। এর দাম বাড়ায় বিশ্বের সব দেশে পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহণ খরচ বেড়ে যায়। বৈশ্বিকভাবেই মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে।
মার্কিন বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের মতে, আশির দশকের পর এই প্রথম বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি বাড়ছে। চলতি বছর শেষ সময় পর্যন্ত এই সংকট মোকাবিলা করতে হতে পারে।
সাধারণত মূল্যস্ফীতি বলতে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্যমূল্য বেড়ে গিয়ে টাকার মান কমে যাওয়াকে বোঝানো হয়। এর মানে হচ্ছে-বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু ভোক্তা একই পণ্য একই পরিমাণে আগে যে দামে কিনত, এখন এর চেয়ে বেশি দামে কিনছে। যে পরিমাণ বেশি দামে কিনছে, তাই মূল্যস্ফীতি। অর্থনীতিতে যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়, তখন ভোক্তার চাহিদাও বাড়ে। ফলে পণ্যের দামও বাড়ে। এ কারণে মূল্যস্ফীতির হার কমাতে মুদ্রার প্রবাহে লাগাম টানা হয়। যেটি এখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশই করেছে। সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রার প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। এতে পণ্য কেনার চাহিদা কমবে। বিপরীতে ধীরে ধীরে দাম কমে আসবে। বিভিন্ন দেশে সাধারণত গড় মূল্যস্ফীতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এক. খাদ্য মূল্যস্ফীতি, দুই. খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি। এগুলোর প্রতিটিরই নানা উপখাত রয়েছে। আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশ খাদ্য, জ্বালানি, অ্যালকোহল, পরিবহণ-এসব খাতে আলাদা মূল্যস্ফীতির হার নিরূপণ করে। মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে ভারতে মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে কৃষকরা বিক্ষোভ করেছেন। জার্মানি, ইতালি, গ্রিস, নেপালসহ আরও অনেক দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্বব্যাপী এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপ, কানাডা, আমেরিকাসহ বেশকিছু দেশ রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ কারণে রাশিয়া থেকে পণ্যের জোগান কমে গেছে। অথচ রাশিয়া ও ইউক্রেনই বিশ্বের জ্বালানি ও খনিজ পণ্যের চাহিদার ৩৪ শতাংশ জোগান দিত। এই জোগান কমে যাওয়ায় পণ্যের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনই সরবরাহও সংকটও প্রকট হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো ছিল ওই দুই দেশের জ্বালানি ও খনিজ পণ্যের ওপর নির্ভরশীল।
এসব পণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ায় তাদের ভারী শিল্পগুলো বসে পড়ে। ইউরোপের প্রায় সব দেশের পণ্যের উৎপাদন কমে যায়। মানুষের আয়ও কমতে থাকে। বাড়তে থাকে পণ্যের দাম। কমে যায় রপ্তানি আয়। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরোর মানে ভয়াবহ পতন শুরু হয়, যা এখনো চলমান। ইউরোর দাম কমায় বাংলাদেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমার বিষয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পণ্যের ও ডলারের দাম বাড়ায় বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে, যা দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবল সংকট তৈরি করেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রায় ১০ টাকা কমে যায় এক বছরের মধ্যে। এতেও মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।
বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। গত নয় বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। গত জুনে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশে। গত মে মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছিল ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার এত বেশি বাড়েনি। জুনে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে।
এদিকে শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ছে। অথচ গ্রামেই এ হার কম হওয়ার কথা। কেননা গ্রামে খাদ্য উৎপাদন হয়। অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, যেখানে পণ্য উৎপাদন হয়, সেখানে সরবরাহ বেশি থাকে, ভোক্তা কম থাকে। এ কারণে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কম থাকার কথা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার শহরের তুলনায় বেশি। গ্রামে কৃষক যে পণ্য উৎপাদন করে সেগুলো বিক্রি করে নগদ অর্থের চাহিদা মেটায়। আবার যখন কৃষক একই পণ্য কিনতে যায়, তখন বেশি দামে কিনতে হয়। কেননা ইতোমধ্যে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য চলে গেছে সিন্ডিকেটের কবজায়। সিন্ডিকেটের কারণে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ছে। গত জুনে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গ্রামে এ হার ছিল ৮ দশমিক ১১ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার এত বাড়েনি।
একই অবস্থা ভারতে। ডলারের বিপরীতে রুপির রেকর্ড দরপতন হয়েছে। প্রতি ডলার এখন ৮০ রুপি। অথচ ছয় বছর আগেও ছিল ৪৬ রুপি। ভারতে ৭ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার এখন সর্বোচ্চ। গত জুনে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ হার গত মে মাসে ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিপণ্যের দাম কমায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। যুক্তরাজ্যে ৪০ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার এখন সর্বোচ্চ। গত জুনে তা বেড়ে ৯ শতাংশে উঠেছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। গত বছরের জানুয়ারিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১ দশমিক ২ শতাংশ। ব্রিটেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংক অব ইল্যাংন্ড’ পূর্ভাবাস দিয়েছে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ হার আরও বাড়বে।
এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে এ খাতেও মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত জুনে এ হার বেড়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। গত মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশটি মূল্যস্ফীতি বলতে সাধারণত ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হারকেই বুঝিয়ে থাকে।
জ্বালানি তেল, অ্যালকোহলসহ অন্যান্য পণ্যের আলাদা মূল্যস্ফীতির হার নিরূপণ করে। আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে রকেট উৎক্ষেপণের কারণে বেশি জ্বালানি ব্যবহারের ফলে এর দাম বেড়ে যায়। এতে বাড়ে খাদ্যের দামও। কর্মীদের মজুরি কমে যায়। ফলে মূল্যস্ফীতির পালে হওয়া লাগে। ওই সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ইউরোপের দেশগুলোয় এখন ১৩ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ। গত জুনে এ হার বেড়ে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বছরের শুরুতে ইউরোপে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ।
ইতালিতে গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। গত মে মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। জার্মানিতে গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। গত মে মাসে তা ৮ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১২ শতাংশের বেশি।
থাইল্যান্ডে ১৩ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ। গত জুনে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি। গত বছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ২ শতাংশের নিচে।
চীনে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যে ৯ শতাংশ। পাকিস্তানে জুনে গড় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। এর মধ্যে খাদ্য খাতে ১৭ শতাংশ। শ্রীলংকায় গড় মূল্যস্ফীতির হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যে ২৬ শতাংশ। দেশটির মুদ্রার মান কমেছে প্রায় ৩৬ শতাংশ।